ছাত্র রাজনীতি নিয়ে ইতিহাস গ্রন্থের লেখক ড. মোহাম্মদ হান্নান বলছিলেন, যে সংগঠন ক্ষমতার স্বাদ পায়, তারা তখন তাদের বিপ্লবী চরিত্র হারিয়ে ফেলে। তখন নানারকম সুবিধাবাদ এবং সুবিধাবাদী লোকজন যুক্ত হয়। তখন সংগঠন বিতর্কিত হয়ে যায়।
বর্তমানে ক্ষমতায় আছে, এমন একটি রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন হিসাবে এখন ছাত্রলীগকে যেভাবে গণমাধ্যমে মানুষ দেখছে, কিন্তু এটাই তো ছাত্রলীগের পুরো ইতিহাস না।
আওয়ামী লীগেরও জন্ম হওয়ার এক বছর আগে জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগের। তখন অবশ্য এই সংগঠনের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। এর একবছর পরে জন্ম হয় আওয়ামী লীগের।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া এই ছাত্র সংগঠন ছিল বাংলা ও বাঙালির অধিকার আদায়ের এক আপসহীন নাম। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সব আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল ছাত্রলীগ। সংগঠনটি পাকিস্তানি জান্তা সরকারের ঘুম হারাম করে দিয়েছিল।
একাত্তরের পরও দেশ গঠনে ভূমিকা রাখেন এই ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সর্বশেষ ’৯০-র স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কিন্তু পরবর্তীকালে এসে ঝিমিয়ে পড়ে এই ছাত্র সংগঠন। নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডসহ বর্তমান গতিহীন, নিস্তেজ সাংগঠনিক অবস্থার কারণে সংগঠনের ভেতরে রয়েছে ক্ষোভ, অভিমান।
গত কয়েক বছরে দেশের নানা এলাকায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণের মতো ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
দুর্নীতি ও চাঁদাবাজিসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ ওঠার পর ২০১৯ সালে ছাত্রলীগের তৎকালীন কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল।
এরপরেও বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, অর্থের বিনিময়ে কমিটি গঠনের মতো অভিযোগ ওঠে।
যেমন ২০১৯ সালে সিলেটের এমসি কলেজে তরুণীতে ধর্ষণের অভিযোগে ছয় ছাত্রলীগ কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সেই বছর বুয়েটের আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে বিচার চলছে বুয়েট ছাত্রলীগের ১৯ নেতাকর্মীর।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশ্যে বিশ্বজিৎ দাসকে কুপিয়ে হত্যার অভিযোগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ২১ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। তাদের আটজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটা বিরোধী আন্দোলনের মতো একাধিক ঘটনায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও মারধর করার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে।
১৯৭১ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগ ছিল একটি সরকার বিরোধী ছাত্র সংগঠন। আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন হলেও ছাত্রলীগের মধ্যে এক ধরনের স্বাতন্ত্র্য কাজ করছিল। তাদের মধ্যে স্বকীয়তা, স্বাধীনতা ছিল। প্রায় প্রতিবছর কাউন্সিল হতো, নেতৃত্বের পরিবর্তন হতো।
কিন্তু একাত্তর পরবর্তী সময়ে আমরা দেখলাম, আওয়ামী লীগ সরকারে গেল আর সরকারি দলের অঙ্গ সংগঠন হলে যা হয়, যেটা আমরা পাকিস্তান আমলে এনএসএফের (তখনকার সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন) মধ্যেও দেখেছি, সেই চরিত্র আস্তে আস্তে ছাত্রলীগের মধ্যে প্রবিষ্ট হতে থাকলো।
ধীরে ধীরে একটা লড়াকু ছাত্র সংগঠন আস্তে আস্তে তার চরিত্র বদলে একটা ক্ষমতাসীন দলের লাঠিয়াল সংগঠনের দিকে যাত্রা শুরু করলো।
সেই সময় সংগঠনের মধ্যেই পক্ষে-বিপক্ষে নানারকম বিভক্তির শুরু হয়। এক দল মনে করলো সরকারের পক্ষে থাকবে, আরেকদল মনে করলো তারা স্বতন্ত্র্য বজায় রাখবে। এভাবে ছাত্রলীগের বিভক্তি ১৯৭২ সালে শুরু হয়। এরপর আওয়ামী লীগ ভাগ হয়েছে, ছাত্রলীগও ভাগ হয়েছে। একসময় তারা ছত্রখান হয়ে গেছে।
আশির দশকে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি বিরোধী দলে ছিল। ফলে তাদের ছাত্র সংগঠনকেও সরকার বিরোধী ভূমিকা দেখা গেছে। কিন্তু সেই আন্দোলনেও ছাত্রদল বা জাসদের ছাত্রলীগ যতটা ভূমিকা রেখেছিল, প্রথম দিকে ছাত্রলীগকে তা দেখা যায়নি।
কারণ আওয়ামী লীগ ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে গিয়েছিল। ফলে সেই আন্দোলনে ছাত্রলীগের তুলনায় ছাত্রদল আগ্রাসী ভূমিকা রেখেছিল। ডাকসুতেও বাসদ এবং জাসদের ছাত্রলীগের প্রাধান্য দেখা গেছে।
কিন্তু এখন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, ছাত্রলীগের কোন স্বাধীন সত্ত্বা নেই। তিন-চার বছর পরে ছাত্রলীগের কাউন্সিল হয়, নিয়মিত হয় না। কাউন্সিলে কোন নেতা নির্বাচিত হন না, নেতা নির্বাচন করে দেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতি। ফলে এটাকে কোন অর্থেই একটি ছাত্র সংগঠন আর বলা যায় না, কারণ এটা ছাত্রদের আর প্রতিনিধিত্ব করে না, এটা প্রতিনিধিত্ব করে ক্ষমতাসীন দলকে।
এটাকে বলা যায় ক্যাম্পাস-ভিত্তিক আওয়ামী লীগের সংগঠন। ফলে ছাত্রলীগের যে ঐতিহ্য আমরা ৫০/৬০ এর দশকে দেখেছি, সেটা এখন পুরোপুরি অনুপস্থিত। তাদের এই ভূমিকার কারণে ছাত্র রাজনীতি পুরোপুরি তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছে।
এসডব্লিউএসএস/১২০০
আপনার মতামত জানানঃ