টেকনোলজির ‘নেক্সট বিগ থিং’ সম্ভবত চলে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে যতটা আলোচনায় ছিল বিশ্বকাপ অতটাই আলোচনায় ছিল চ্যাট জিপিটি। সান ফ্রান্সিসকো ভিত্তিক আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ওপেনএআই নামক একটি সংস্থা দ্বারা তৈরি করা হয়েছে এই চ্যাটবট। Chat GPT-এর ফুল ফর্ম হল চ্যাট জেনেরেটিভ প্রিটেন্ড ট্রান্সফর্মার (Chat Generative Pretend Transformer)। এটিকে ওপেন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর মাধ্যমে নির্মাণ করা হয়েছে যা এক প্রকার চ্যাট বট। এটি শুধুমাত্র আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর উপর কাজ করবে।
নভেম্বরের ৩০ তারিখে উন্মুক্ত হবার পর মাত্র পাঁচ দিনে এই চ্যাট জিপিটি এক মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার অতিক্রম করে গেছে। যেটি পৃথিবীতে এই মুহূর্তে একটি রেকর্ড। কারণ অন্যতম জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া টুইটারের এক মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার হতে সময় লেগেছিল প্রায় দুই বছর। ফেসবুকের লেগেছিল ১০ মাস। ড্রপবক্সের লেগেছিল ৭ মাস। স্পোটিফাইয়ের লেগেছিল ৫ মাসেরও বেশি।
এর অর্থ হচ্ছে ভবিষ্যতে চ্যাট জিপিটির ব্যবসায়ের পরিধি হবে বিশাল। এটির যেমন অনেক দারুন ফিচার রয়েছে তেমনি কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। অনেকে দাবি করছে যে, ভবিষ্যতে হয়তো এ প্রযুক্তি গুগলের পরিবর্তে ব্যবহৃত হবে। মানুষ গুগলের পরিবর্তে এ চ্যাট বটকে প্রাধান্য দিবে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কাজ করা এই পৃথিবীতে এখন যতগুলো কোম্পানি আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো ওপেনএআই। এর অন্যতম কারণ হলেন ইলন মাস্ক। ২০১৫ সালে ইলন মাস্ক ও স্যাম অল্টম্যান সহ আরো ছয় জন মিলে ওপেনএআই প্রতিষ্ঠা করেন। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কাজ করার জন্য এটি ছিল একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এরপর ২০১৮ সালে ইলন মাস্ক কোম্পানি থেকে রিজাইন করেন এবং ২০১৯ সালে মাইক্রোসফট এই কোম্পানিটিতে এক বিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করেন। এই ওপেনএআই কোম্পানির নতুন প্রোডাক্ট হলো চ্যাট জিপিটি। চ্যাট জিপিটির বর্তমানে তিনটি ভার্শন আছে। যার মধ্যে এখন চলমান আছে ৩.৫ ভার্শন। বর্তমানে চ্যাট জিপিটির মার্কেট ভ্যালু ২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। পাশাপাশি ওপেন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সিইও অল্টম্যানের অনুসারে চ্যাট জিপিটি এখন পর্যন্ত ২০ মিলিয়নেরও বেশি ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছেছে এবং তাদের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বাড়ছে।
এখনও পর্যন্ত ওপেন এআই এর ক্ষেত্রে সাড়া ফেলেছিলো Dall-E, এটি ছিল একটি ওপেন এআই ইমেজ জেনারেটর। যা টেক্সট থেকে ছবি তৈরি করতে সাহায্য করত। তবে চলতি বছর নভেম্বর মাসে চ্যাট জিপিটির আগমনের ফলে সোশ্যাল মিডিয়ায় টেক উৎসাহীদের মধ্যে হইচই পড়ে যায়। কিন্তু কী এই চ্যাট জিপিটি? এই প্রযুক্তি নিয়ে সবাই এত উদ্দীপিত কেন? চলুন কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
চ্যাট জিপিটি কী?
চ্যাট জিপিটি হল একটি চ্যাট বট যা কিনা ব্যবহারকারীর টেক্সটের উত্তর দিতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের উপর নির্ভর করে। যা আমরা মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপে দেখে থাকি। তবে এটির গঠন এবং কাজ করার পদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা। এই চ্যাটবট তৈরি করা হয়েছে জিপিটি থ্রি (জেনারেটিভ প্রিট্রেইনড ট্রান্সফরমার ৩) এর উপর ভিত্তি করে। যা একটি ডিপ লার্নিং ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল। প্রসঙ্গত, ডিপ লার্নিং হল একটি মেশিন লার্নিং মেথড। যেখানে নিউরাল নেটওয়ার্কের তিন বা তার বেশি স্তর থাকে। এই নেটওয়ার্ক মানুষের মানসিক আচরণ ধরার চেষ্টা করে থাকে।
এটি একটি অত্যাধুনিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণ এআই মডেল ওপেনএআই দ্বারা তৈরি। আর এটি মানুষের মতো লিখিত টেক্সট জেনারেট করার ক্ষেত্রে দারুন পারদর্শী। অর্থাৎ এই চ্যাটবট মানুষের মতো টেক্সট তৈরি করতে সক্ষম। ইউজারের যে কোনও প্রশ্নের উত্তর খুব গঠনমূলক এবং সহজ ভাবে প্রদর্শন করে এই চ্যাটবট।
ওপেনএআই-এর বক্তব্য, চ্যাটজিপিটি ফলো-আপ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, এমনকি তার ভুল পর্যন্ত স্বীকার করতে পারে। এটি এমন অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারে, যা একে বৈধ বলে বিবেচিত করে না।
এর সুবিধা কী?
এআই মডেলের দ্বারা তৈরি চ্যাটবট সম্পূর্ণ নির্ভুল এবং যুক্তিযুক্তভাবে রেজাল্ট প্রদর্শন করে। যার ফলে ইউজারের বুঝতে সুবিধা হয়। এবং কোনও তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ অর্থাৎ বিজ্ঞাপন ছাড়াই কাজ করে এই চ্যাটবট। এই চ্যাটবট আপনার জন্য কবিতা লিখে দিতে পারে, আপনার পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর লিখে দিতে পারে, অর্থনীতি-রসায়ন থেকে শুরু করে একাধিক প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম এই চ্যাটবট।
এই ওপেনএআই চ্যাটবট ইন্টারনেটে উপলব্ধ টেক্সট ডাটাবেস থেকে প্রশিক্ষিত। ইন্টারনেটে থাকা ওয়েব পেজ, ওয়েব টেক্সট, বই, উইকিপেডিয়া, আর্টিকেল সহ বিভিন্ন সোর্স থেকে প্রায় ৫৭০ জিবির বেশি ডাটা সমৃদ্ধ এই চ্যাট জিপিটি।
শুধু তাই নয় এই চ্যাট বটে রয়েছে ৩০০ বিলিয়ন শব্দের ভান্ডার। পাশাপাশি এটি একটি বাক্যের পরবর্তী শব্দটি কী হওয়া উচিত তা অনুমান করতেও সক্ষম।
ঝুলিতে রয়েছে সব প্রশ্নের উত্তর। মানুষের মতোই ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারে। গুগল সার্চ ইঞ্জিনের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বি এই চ্যাট জিপিটির সহজ ও নির্ভুল উত্তর পেতে মানুষের ঢল নেমেছে। গত নভেম্বর মাসে লঞ্চ হওয়ার পর এক মাস না গড়াতেই এই প্রযুক্তি নিয়ে মজেছে নেটদুনিয়া। ইউজারদের দাবি, গুগল সার্চের তুলনায় দ্রুত ও ত্রুটিহীন রেজাল্টের জন্য অত্যন্ত সহায়ক চ্যাট জিপিটি।
পাশাপাশি রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং উইথ হিউম্যান ফিডব্যাক (আরএলএইচএফ) প্রশিক্ষণ চ্যাট জিপিটিকে আরো বেশি মানুষের মতো উত্তর দিতে সহায়তা করে। যে কোনো প্রশ্ন বিশ্লেষণ করে মানুষের মতো উত্তর প্রদানের সক্ষমতা এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই চ্যাট জিপিটি অর্জন করে।
লার্নিং ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল অনেক ক্ষেত্রেই বুঝতে ব্যর্থ হয় যে, কোন একটি প্রশ্নের দ্বারা মানুষ কি জানতে চাইছে। আর এখানেই আরএলএইচএফ ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে।
তবে কিছু সুবিধা থাকলেও চ্যাট জিপিটি নিয়ে এখনও নিশ্চিত নয় অনেকেই। মূলত, এই চ্যাট বটে কেবল টেক্সট রেজাল্ট পাওয়া যায়। ভিডিও বা ভিজ্যুয়াল রেজাল্ট আসে না। শুধু এটা নয়, সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ঘটনা বা বিষয় সম্পর্কে এটি উত্তর দিতে সক্ষম নয়। কারণ এটির সিস্টেমে যে ডাটাবেস রয়েছে তা তুলনামূলক পুরোনো এবং এটির সিস্টেমে যে ডাটাবেস রয়েছে সেই অনুযায়ী এটি উত্তর প্রদর্শন করে। কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে তা একেবারে সঠিক নাও হতে পারে।
চ্যাট জিপিটি ব্যাবহারের পদ্ধতি
এটি ব্যবহার করার জন্য সবার প্রথম এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে https://chat.openai.com/ -এ যেতে হবে এবং আপনাকে এখানে একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে।
একাউন্ট খোলার সময় মোবাইল নম্বর টা সঠিক দেবেন কারণ মোবাইলে একটি ওটিপি (otp) জেনারেট হবে। আপনার অ্যাকাউন্ট তৈরি হবার পরেই আপনি চ্যাট জিপিটি ব্যবহার করতে পারবেন।
ব্যাকফুটে গুগল
চ্যাট জিপিটির এই সাফল্য দেখে কার্যত চিন্তায় পড়ে গেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সার্চ ইঞ্জিন গুগল। কারণটা আশাকরি সবাই অনুমান করতে পেরেছেন। আসলে গুগল সার্চ ইঞ্জিন সংস্থার মোট রেভেনিউয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ অবদান রাখে। তাই এই ক্ষেত্রে চ্যাট জিপিটি তথা এআই সার্চ টুলের জনপ্রিয়তা তাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তা দেখে সম্প্রতি ‘কোড রেড’ ঘোষণা করেছে টেক জায়েন্ট গুগল।
কোড রেড হল গুগলের আসন্ন চ্যাট বট। যা চ্যাট জিপিটি-কে টেক্কা দেবে। কিন্তু তাজ্জব করা বিষয় হল, ২০ বছর ধরে যে সংস্থা সার্চ ইঞ্জিনের ব্যবসায় রয়েছে তারা প্রযুক্তির অগ্রগতির কথা মাথায় রেখে এআই চ্যাট বট তৈরি করতে পারেনি? আপনার মাথায়ও যদি এমন প্রশ্ন আসে তাহলে বলে রাখি, গুগলের ইতিমধ্যে একটি এআই চ্যাটবট রয়েছে নাম LaMDA। কিন্তু গুগল এটিকে জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করতে আগ্রহী নয় কারণ খ্যাতিমূলক ঝুঁকির সম্ভাবনা দেখছে তারা।
যদি গুগলের চ্যাট বট কোনও ভুল উত্তর দিয়ে থাকে তাহলে গুগলের খ্যাতির উপর বড় প্রভাব পড়বে। কারণ এই সংস্থা থেকে ইউজারদের প্রত্যাশা অনেক। সূত্রের খবর, চ্যাট জিপিটি সহ অন্যান্য এআই চ্যাট বটদের প্রতিযোগিতা দিতে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করছে গুগল। এর জন্য আলাদা টেক টিম তৈরি করতে উদ্যোগী হয়েছে সংস্থাটি।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মার্গারেট ও’মারা এর মতে, কোনও সংস্থাই অপরাজেয় নয়; সবাই অরক্ষিত। যে সংস্থাগুলো একটি বাজার-সংজ্ঞায়িত কাজ করে অসাধারণভাবে সফল হয়েছে, তাদের জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু দিয়ে দ্বিতীয় কাজ করা কঠিন।
কিন্তু এই প্রসঙ্গে গুগলের ইঞ্জিনিয়ার ব্লেক লেমোইনের দাবি, খুব সংবেদনশীল বিষয় এটি। এই প্রযুক্তি দেখিয়েছে যে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চ্যাটবট প্রযুক্তি কতটা উন্নত হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের একাংশের বিশ্বাস সার্চ ইঞ্জিনকে সংশোধন করার পরিবর্তে সেটিকে আরও উন্নত করার পথই বেছে নেবে গুগল।
এসডব্লিউএসএস/১৪১৫
আপনার মতামত জানানঃ