ধীরে ধীরে সিলেবাস বদল হতে হতে, বিশেষত ইতিহাস বারবার পুনর্লিখিত হওয়ার ফলে, ভারতের নানা ক্ষেত্রে মুসলমানদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও অবদানের কথা একরকম ধামাচাপা পড়ে গেছে। এর ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে তা অজানা। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখাদের একজন কিচলু।
শুধু তাই নয়, মানুষকে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সারাজীবন কাজ করেছেন সাইফুদ্দিন কিচলু। তার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ। এক সময় কিচলুর পূর্বপুরুষ প্রকাশরাম কিচলু ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
কিচলুর দাদা আহমেদ জো, ১৮৭১ সালে কাশ্মীরে দুর্ভিক্ষের পর পাঞ্জাবের অমৃতসরের ফরিদকোটে চলে আসেন। সেখানেই জন্ম হয় কিচলুর।
তার বাবার নাম আজীজুদ্দিন কিচলু এবং মায়ের নাম দান বিবি। কিচলুর বাবার পাশমিনা ও জাফরানের ব্যবসা ছিল। তিনি ‘শিশমহল’ নামে একটি মিলনায়তন নির্মাণ করেন, যেখানে সংগীতানুষ্ঠান, সাহিত্যসভা, খেলাধুলা ইত্যাদি অনুষ্ঠান হতো। এ রকম পরিবেশ পরবর্তীকালে সাইফুদ্দিনকে একজন সংকীর্ণতামুক্ত উদার মানুষ হতে সাহায্য করেছিল।
কিচলু অমৃতসরের ইসলামিয়া হাইস্কুল শেষ করার পর লন্ডনের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেন এবং এরপর বার-অ্যাট-ল’ করেন। তারপর তিনি জার্মানিতে গিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী ও তরুণ-তরুণী জাতীয়তাবাদে আকৃষ্ট করার জন্য কাজ করেছেন। তরুণদের জাতীয় কাজকর্মে ও হিন্দু-মুসলিমকে একতার বন্ধনে আকৃষ্ট করার জন্য ১৯২১ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ‘স্বরাজ আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৫২ সালের ২২ ডিসেম্বর ভারতীয় উপমহাদেশের এই রাজনীতিবিদ প্রথম লেনিন শান্তি পুরস্কার অর্জন করেন। ভারতীয় ডাক বিভাগ ১৯৮৯ সালে তার নামাঙ্কিত একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করেছিল।
সাইফুদ্দিন কিচলু পাঞ্জাবে কংগ্রেস পার্টির প্রধান হয়েছিলেন। ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় জাতির জীবনের সেই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য অসহযোগ আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের বীজ বপন হয়।
রাওলাট অ্যাক্ট এবং জালিয়ানওয়ালাবাগে তার ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। কিচলু জালিয়ানওয়ালাবাগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন ১৯১৯ সালের মার্চ মাসে, ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল রাউলাট অ্যাক্ট পাস করে, যা যুদ্ধকালীন জরুরি ব্যবস্থার সাংবিধানিক বৈধতা দেয়। এই একটি আইন সরকারকে ক্ষমতা দিয়েছে, প্রেসকে আটকে রাখার, ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেফতার করার এবং বিপ্লবীদের ইচ্ছামতো আটক করার।
নতুন অমানবিক রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে সারা দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। কিচলু বেশ কয়েকটি বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেন এবং স্থানীয়দের তাদের ব্যবসা বন্ধ করতে এবং অসহযোগ আন্দোলনে যোগদানের জন্য অনুরোধ করে ধর্মঘট করেন। ১৯১৯ সালের ৩০ মার্চ তার সভায় প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। তার সভায় তিনি বেশ কিছু ঔপনিবেশিক বিরোধী মন্তব্য করেন এবং এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য জনগণকে আহ্বান জানান। কিন্তু এই সমস্ত প্রতিবাদ সহিংস ছিল না এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করেছিল।
সময় ১৯৪৭ সাল, সেই সময় দেশ ভাগের সময় কিচলুর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর তিনি পাঞ্জাব ছেড়ে দিল্লিতে চলে আসেন। বাকি জীবনটা তিনি রাজনৈতিক ও ডিপ্লোম্যাটিক লেভেলে সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছিলেন। এ জন্য তাকে লেনিন শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়
এই বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের ঘোরবিরোধী ছিলেন। বিভিন্ন জনসভায় ‘সাম্প্রদায়িকতার কাছে জাতীয়তার আত্মসমর্পণ’ অর্থাৎ ‘সারেন্ডার অফ ন্যাশনালিজম ফর কমিউনালিজম’ বলে আখ্যায়িত করেন। দেশ বিভাগের কয়েক বছর পরে তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দিকে ঝুঁকে পড়েন।
এসডব্লিউএসএস/১৭৫২
আপনার মতামত জানানঃ