প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা শনিবার গণভবনে হেফাজত নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন৷ হেফাজত কোনো রাজনৈতিক দল না হলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব আছে বলে ধারণা করা হয়৷ আবার হেফাজত নেতাদের অনেকেই ভিন্ন ভিন্ন ইসলামি দলের নেতা৷ প্রধানমন্ত্রী হেফাজত নেতাদের কাছে দেশের আরো খেদমত করার জন্য দোয়া চেয়েছেন৷ আর হেফাজত নেতারা তাদের কারাগারে আটক নেতা-কর্মীদের মুক্তি চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে৷
শাপলা চত্বরের ঘটনায় সময় হেফাজত সরকার ও আওয়ামী লীগ বিরোধী ছিলো৷ সর্বশেষ তারা ভাস্কর্যকে মুর্তি আখ্যা দিয়ে আন্দোলনে নেমেছিল৷ তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করে৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সরকারের কৌশলে তারা রণে ভঙ্গ দেয়৷ এরই মধ্যে হেফাজত নেতারা মুক্তি পেতে শুরু করেছেন৷ রোববার হেফাজত নেতা মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন৷
এদিকে, জামায়াতে ইসলামির সঙ্গে বিএনপির যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, সেখানেও বদল এসেছে৷ গত ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে এই দূরত্ব অনেকটাই কমে এসেছে বলে মনে হচ্ছে৷ গত আগস্টে বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব প্রকাশ পায় জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্যে৷ তিনি তখন জামায়াতের এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে বলেন, ‘‘আমরা এতোদিন একটা জোটের সঙ্গে ছিলাম৷ ছিলাম বলে আপনারা হয়তো ভাবছেন কিছু হয়ে গেছে নাকি? আমি বলি হয়ে গেছে৷ ২০০৬ সাল পর্যন্ত এটি একটি জোট ছিলো৷ ২০০৬ সালের ২৮শে অক্টোবর জোট তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে৷ সেদিন বাংলাদেশ পথ হারিয়ে ছিলো৷ সেটা আর ফিরে আসেনি৷বছরের পর বছর পর এই ধরনের অকার্যকর জোট চলতে পারে না৷”
এরপর বিএনপি নেতারাও জামায়াত নিয়ে ছিলেন চুপচাপ৷ কিন্তু ১০ ডিসেম্বর সমাবেশের আগে জামায়াত নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয় বিএনপির৷ জামায়াত বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যোগ দেয়৷ তারা বিএনপির ১০ দফায় সমর্থন দিয়েছে৷ ১০ ডিসেম্বর জামায়াত আমীর ডা. শফিকুর রহমানও বিএনপির সঙ্গে মিলিয়ে ভার্চুয়াল মাধ্যমে ১০ দফা ঘোষণা করেন৷ জামায়াত বিএনপির ঘোষিত সব কর্মসূচির সঙ্গে একই সময়ে, একই দিনে যুগপৎ কর্মসূচি দিচ্ছে৷ এরইমধ্যে জাময়াতের আমির গ্রেপ্তার হয়েছেন৷ বিএনপি বলেছে, তারা একমাত্র আওয়ামী লীগ ছাড়া সব দলকেই তাদের সঙ্গে চায়৷
আ’লীগ নাকি বিএনপি-কাদের পাল্লা ভারী?
দেশে বিভিন্ন রাজনৈদিক দল ও জোটের সঙ্গে কম বেশি ৭০টি ইসলামি দল যুক্ত আছে বলে জানা যায়৷ এরমধ্যে আওয়ামী লীগের ১৪ দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত আছে চারটি ইসলামি দল৷ মিত্র হিসেবে আছে আরো ২৫টি অনিবন্ধিত ইসলামি রাজনৈতিক দল৷ জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে সম্মিলিত জাতীয় জোটে আছে মোট ৩২টি ইসলামিক দল৷ আর বিএনপির ২০ দলীয় জোটে আছে পাঁচটি ইসলামি দল৷ মিত্র হিসেবে আছে আরো কয়েকটি দল৷
এই জোটগুলো গড়ে ওঠে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে৷ এরপর কয়েকটি দল অবশ্য জোট ছেড়েছে৷ তখন নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার আশায় ছোট-বড় অনেক ইসলমি দল বিভিন্ন জোটে যোগ দেয়৷ তবে নির্বাচনের পর তাদের আর জোট কেন্দ্রিক তেমন কোনো তৎপরতা চেখে পড়েনি৷ এখন তারা আবার সক্রিয় হয়েছে৷ বড় দলগুলোও তাদের শক্তি বাড়াতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে৷
বাংলাদেশে রাজনীতিতে ৭০টির মতো ইসলামি দল সক্রিয় থাকলেও ১৫০ টির বেশি ইসলামি দল রয়েছে৷ যারা সক্রিয় নয় তাদের মধ্য থেকেও কিছু দলকে সক্রিয় করে জোটকে ভারি করার চেষ্টা হচ্ছে বলে জানাগেছে৷
বড় ইসলামিক দলগুলো মধ্যে চরমোনাই পীরের ইসলামি আন্দোলন কোনো জোটভুক্ত নয়৷ তারা কোনো জোটভুক্ত না হয়ে নিজেরাই একটি বড় ইসলামি দলগুলোর জোট করতে চায়৷
ইসলামি দলগুলো কেন গুরুত্বপূর্ণ?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনীতি বিশ্লেষক শেখ হাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘ভোট ও আন্দোলনের শক্তি বাড়াতে বড় দুই দলই ইসলামি দলগুলোকে কাছে টানে৷ এক্ষেত্রে কোনো আদর্শ কাজ করে না৷ কিন্তু বাস্তবতা হলো তারা ভোটে একটা ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে৷ তাই ভোটের রাজনীতিতে কোনো আদর্শ থাকেনা৷”
তিনি আরো বলেন, ‘‘হেফাজতের মত সংগঠনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী যখন বৈঠক করে তখন তা আওয়ামী লীগের জন্য দু:খজনক৷ তারা নারী নীতি বিরোধী৷ তার পাঠ্যপুস্তকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও হুমায়ুন আজাদের মত সাহিত্যিকদের লেখা বিরোধী৷ তাদের দাবি মেনেও নেয়া হয়৷ হেফাজত কোনো রাজনৈতিক দল না হলে বিভিন্ন দলে তাদের প্রভাব আছে৷ ভোটে তাদের প্রভাব আছে৷ তারা একটা বড় ফ্যাক্টর৷ সেই বিবেচনায় হয়তো হেফাজতকে কাছে রাখতে চাইছে আওয়ামী লীগ৷”
‘‘অন্যদিকে জামায়াত আন্দোলন ও ভোট দুই দিকেই একটি ফ্যাক্টর৷ তারা কোনো জোটে গেলে তাদের ভোট বেড়ে যায়৷ তাই বিএনপি স্বাধীনতা বিরোধী দলটিকে সব সময়ই সাথে রাখে৷ বিএনপির মধ্যেও এর বিরোধিতা আছে৷ তারপরও জামায়াত ছাড়ছে না বিএনপি৷ এর একটি ভিন্ন কারণও আছে৷ তাদের আন্তর্জাতিকসহ নানামুখী যোগাযোগকে বিএনপি তার পক্ষে কাজে লাগাতে চায়৷ যার ফলে জামায়াতকে ছাড়া বিএনপির পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে।”
তিনি মনে করেন, ‘‘ধর্ম ভিত্তিক দলগুলোকে বাদ দিয়েও বড় দুই রাজনৈতিক দল নির্বাচন, আন্দোলনে ভালো করতে পারে৷ তার প্রমাণও আছে৷ কিন্তু এখন তারা যেভাবে জড়িয়ে পড়েছে তাতে ধর্মভিত্তিত দল ও সংগঠনগুলোকে তাদের পক্ষে আর উপেক্ষা করার সুযোগ নেই৷ তাদের প্রভাব দিন দিন আরো বাড়বে৷”
ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিযোগিতা
সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিম মনে করেন, ‘‘এখানে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিযোগিতা হচ্ছে৷ নীতি, আদর্শ বলতে কিছু নেই৷ এর সঙ্গে গণতন্ত্র বা নাগরিকদের কল্যাণের কোনো সম্পর্ক নেই৷ তাই যে যেভাবে পারছে তাকে দলে টানাছে৷ ভোট বাড়াচ্ছে৷ শক্তি বাড়াচ্ছে৷ বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে হিসাব আছে যে ইসলামি দলগুলোর হাতে কত ভোট আছে৷ এখানে মসজিদ, মাদ্রাসা কেন্দ্রিক অনেক ভোট৷ সেই হিসাব করে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কাছে টানছে৷ তাই বিএনপির জন্য জামায়াত আর আওয়ামী লীগের জন্য হেফাজত অনিবার্য হয়ে উঠেছে৷”
তার কথা, ‘‘ওই দলগুলোকে তারা যে খুব মর্যাদা দেয় তা নয়৷ স্বার্থ হাসিলের জন্য তাদের ছিটোফোটা দিয়ে কাছে রাখে৷”
তিনি বলেন, ‘‘এই ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতির কারণে রাষ্ট্রের আদর্শিক অবস্থানও নষ্ট হচ্ছে৷ কোনো চরিত্র গড়ে উঠতে পারছেনা৷ এথেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন সঠিক ও শক্তিশালী নেতৃত্ব৷ সেটার বড় অভাব বাংলাদেশে৷”
‘‘আর যারা এনিয়ে কথা বলবেন সেই বুদ্ধিজীবী শ্রেণিও কচ্ছপের মতো হয়ে গেছে৷ তারা বিপদ দেখলে মাথা ভিতরে ঢুকিয়ে ফেলে৷ বুদ্ধিজীবীরা নগদজীবী হয়ে গেছেন৷ মাস্টাররা বিভিন্ন পদ পেয়ে যাচ্ছেন, তাতেই সব হয়ে যাচ্ছে৷”
এসডব্লিউএসএস১৫১৯
আপনার মতামত জানানঃ