আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে একটি জোট গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছিল। পরিকল্পনার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। কয়েকটি দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সংলাপও করেছিল তারা।
কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ওই প্রক্রিয়া থেকে পিছু হটছে দলগুলো। তাদের নজর এখন পর্দার আড়ালের ঘটনার দিকে।
ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, বিএনপি ও জোটের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। আবার নির্বাচন ঠেকানোর মতো আন্দোলন-সংগ্রামেও ছিল না তারা। তখন ধর্মভিত্তিক বেশকিছু দলের স্বপ্ন ছিল, তারা নিজেরা এবং সরকারের ঘনিষ্ঠ আরও কয়েকটি দলের সমন্বয়ে একটি বৃহত্তর জোট গঠন করে বিরোধী দল হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া।
সেই লক্ষ্যে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে এক টেবিলে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে কয়েকটি দলের সঙ্গে সংলাপও করে। কিন্তু বর্তমানে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সারা দেশে আন্দোলনে নেমেছে। অন্যদিকে, আন্দোলনে সরকারের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো বাধাও আসছে না।
তাই ধর্মভিত্তিক দলগুলো মনে করছে, এর পেছনে কোনো কারণ আছে। পর্দার আড়ালে কোনো ঘটনা ঘটছে। ফলে, এ মুহূর্তে সরকারি জোটের সঙ্গে ঝুঁকে পড়া অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত হবে। আবার বিএনপিসহ অন্যান্য দলের মাঠের আন্দোলনের চাঙাভাব দেখে তাদের সঙ্গে গেলে সরকারের রোষানলে পড়তে হবে। সে কারণে জোট গঠনের প্রক্রিয়া থেকে পিছু হটতে হয়েছে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে।
দলগুলোর নেতারা আরও বলছেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আগামী বছরের জুন-জুলাইয়ে আবারও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর এক টেবিলে আসা বা জোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হবে। ওই প্রক্রিয়া শেষ করে এর চূড়ান্ত রূপ পেতে আগস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। নির্বাচনের সময়ও ঘনিয়ে আসবে। তখন যদি সরকারি দলের অবস্থান শক্তিশালী হয় তাহলে তাদের সঙ্গে ভিড়বে ধর্মভিত্তিক দলগুলা।
যদি মাঠে বিরোধী দলগুলোর অবস্থান ভালো পরিলক্ষিত হয়, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মেনে নিতে সরকারকে যদি তারা বাধ্য করতে পারে তাহলে অধিকাংশ ধর্মভিত্তিক দল সেখানে ভিড়বে। তবে, এক্ষেত্রে গত বছর সরকারের চাপে পড়ে বিএনপি জোট ছেড়ে যারা এসেছে, বিশেষ করে খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম; তারা কি আবারও তাদের সঙ্গে যাবে নাকি সরকারি দলের দিকে ঝুঁকবে— সেটা এখনও পরিষ্কার নয়।
সংশ্লিষ্টদের মতামত
এ প্রসঙ্গে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব ইউনুস আহমাদ সেখ বলেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে আমরা কয়েকটি দলের সঙ্গে সংলাপ করেছি। আমার খেলাফত মজলিস, জমিয়ত, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনসহ কয়েকটি দলের সঙ্গে বসেছি। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে একটি টেবিলে নিয়ে আসা। নিজেদের মধ্যে একটি জোটও হতে পারে, আবার সমঝোতাও হতে পারে। কিন্তু এটা নিয়ে খুব তাড়াহুড়া নেই। সময় নিয়ে কাজ করছি আমরা।
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমির আতাউল্লাহ হাফেজ্জী বলেন, হাফেজ্জি হুজুরের নীতি ও আদর্শ মেনে কেউ যদি আমাদের সঙ্গে জোট করতে আসে, আমরা চিন্তা করব। ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে বৈঠকে এতটুকু আলোচনা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশকে বলেছি, আপনারা আলোচনায় বসে যেসব কথা বলেন, মাঠে-ময়দানে তার ভিন্ন পরিচয় দেন। আপনাদের কথা ও কাজে ভিন্নতা থাকে।’
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী বলেন, ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে আমাদের কোনো আলোচনা হয়নি। এ মুহূর্তে ধর্মভিত্তিক দলগুলো নিয়ে জোট গঠনের কোনো কার্যক্রম বা প্রক্রিয়া শুরু হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর এক শীর্ষ নেতা বলেন, গত এক-দুই মাস আগেও দেশের রাজনৈতিক যে পরিস্থিতি ছিল, সেটা এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর অনেকের খায়েশ ছিল বিএনপি আগামী নির্বাচনে না আসলে তারা বিরোধী দল হবে। কিন্তু গত এক-দুই মাস বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দল যেভাবে রাজনীতিতে সক্রিয় উপস্থিতি জানান দিচ্ছে, সারা দেশে সভা-সমাবেশ করে বেড়াচ্ছে এবং সরকারও তেমন একটা বাধা দিচ্ছে না…, তখন ধর্মভিত্তিক দলগুলোর বিরোধী দল হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় বেশ ভাটা পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, এ মুহূর্তে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর জোটবদ্ধ হয়ে সরকারের পক্ষে যাওয়া কিংবা বিরোধী দলের দিকে ঝোঁকা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, এখন যদি আমরা বিরোধী দলের সঙ্গে যাই, তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে দমন-নিপীড়ন বাড়বে। তাই ধর্মভিত্তিক দলগুলো সময় নিচ্ছে। হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে অদূরদর্শী। এখন সবার নজর পর্দার আড়ালে কী ঘটছে সেদিকে লক্ষ রাখা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকটি ধর্মভিত্তিক দলের আমির বলেন, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে জোট গঠনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, সেটা এখন থমকে গেছে। আগামী বছরের জুন-জুলাই থেকে এটা আবার শুরু হবে। কারণ, তখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। পর্দার আড়ালের ঘটনাগুলো সব সামনে চলে আসবে।
রাজনৈতিক মাঠে কার শক্ত অবস্থান, কার অবস্থান দুর্বল— তাও বোঝা যাবে। বিদেশি শক্তিগুলো সরকারের দিকে থাকবে নাকি বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে থাকবে— সে বিষয়েও পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে গিয়ে ধর্মভিত্তিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে ঐক্য করবে নাকি সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশ নেবে— সেটাও ঠিক হয়ে যাবে।
ধর্মীয় এ নেতা আরও বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে খেয়াল করলে বোঝা যায় পর্দার আড়ালে কিছু একটা হচ্ছে। সরকারের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে তারা কোথাও দুর্বল হয়ে পড়ছে। আমরা সেটা বোঝার চেষ্টা করছি।
ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব ও সাবেক হেফাজতের নেতা মুফতি ফয়জুল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, ধর্মভিত্তিক দলগুলো সমন্বয়ে জোট গঠনের প্রক্রিয়া খুব বেশি অগ্রসর হয়নি। এখনও সময় হয়নি। এছাড়া নিজেদের কিছু করার চিন্তা-ভাবনা থাকলে সেটাও পরে করা যাবে।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আগামী বছরের জুন-জুলাইয়ে আবারও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর এক টেবিলে আসা বা জোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হবে। ওই প্রক্রিয়া শেষ করে এর চূড়ান্ত রূপ পেতে আগস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে
আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের সভাপতি সৈয়দ বাহাদুর শাহ মুজাদ্দেদী বলেন, আমরা এখনও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে আছি। যদিও এ জোটের কোনো কার্যক্রম নেই। তারপরও জোট ছেড়ে আসিনি। জোট ছেড়ে না আসা পর্যন্ত অন্য কোনো জোটে যাব কি না, সেটা বলতে পারছি না।
খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক বলেন, আমরা কোনো জোটে যাব না। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক জোট হলেও যাব না।
খেলাফত মজলিসের মতো বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট কোনো ধর্মভিত্তিক জোটে যাবে না— উল্লেখ করে দলটির চেয়ারম্যান এম এ মতিন বলেন, ‘আমরা ধর্মভিত্তিক কোনো জোটে যাব না। কারণ, দলগুলোর কিছু বিএনপি, কিছু জামায়াত আর কিছু আওয়ামী লীগের ইশারায় পরিচালিত হয়। কিছু উগ্রবাদী ধারায় পরিচালিত হয়। তাই কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা নেই।’
৩০০ আসনে প্রার্থিতা দেওয়ার প্রস্তুতি
তবে, আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে ধর্মভিত্তিক দলগুলো ইতিবাচক। দু-একটি দলের ক্ষেত্রে ভিন্ন মত আছে। দলগুলোর নেতারা বলছেন, ধর্মভিত্তিক দলগুলোর এককভাবে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার মতো সাংগঠনিক অবস্থা নেই। যার যেখানে সাংগঠনিক শক্তি মজবুত, সে সেখানে প্রার্থী দেবে। এভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছে দলগুলো।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব ইউনুস আহমাদ এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ৩০০ আসনে প্রার্থিতা দেওয়ার প্রস্তুতি আছে আমাদের।
ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা। সবাই তা নেয়। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায়?
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমির আতাউল্লাহ হাফেজ্জী বলেন, ৩০০ আসনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার চিন্তা আছে আমাদের। তারপরও যতটুকু পারি করব।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী বলেন, আমরা নির্বাচনমুখী দল। অতীতের সব নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। এবারও অংশ নেব।
ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের সভাপতি সৈয়দ বাহাদুর শাহ মুজাদ্দেদী বলেন, আমরা নির্বাচনে অংশ নেব। তবে, ডিসেম্বরের পর চিন্তা করব এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেব, নাকি অন্যভাবে অংশ নেব।
নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকার ছাড়া খেলাফত মজলিস কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না— উল্লেখ করে মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক বলেন, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশন সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে।’ এটা কি তার সিদ্ধান্ত নাকি দলের— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার সিদ্ধান্ত। দলের সিদ্ধান্তও হয়ে যাবে।’
কারাবন্দি হেফাজতের সাবেক নেতা মাওলানা মামুনুল হকের দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। দলটির একাধিক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের অধীন কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। শুধু তা-ই নয়, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো জোট হলে, সেটা যদি আওয়ামী লীগের সঙ্গে হয়, সেখানেও তারা থাকবে না।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৩৫
আপনার মতামত জানানঃ