নিত্যপণ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, পুলিশের গুলিতে নেতা-কর্মী নিহত এবং চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে দেশের সব বিভাগে বিএনপির গণসমাবেশের অংশ হিসেবে আজ ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ করছে বিএনপি।
তবে এই বিজয়ের মাসে বিএনপির এই সমাবেশের স্থানকে কেন্দ্র করে গোটা দেশে যা ঘটল, তা একটি গণতান্ত্রিক দেশে একেবারেই অপ্রত্যাশিত। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ন্যূনতম যে কর্মসম্পর্ক থাকার কথা, তা এখন নেই। আগেও ছিল না।
আজ শনিবার বেলা ১১টা থেকে রাজধানীর সায়দাবাদের গোলাপবাগ মাঠে বিএনপির গণসমাবেশ শুরু হয়েছে। সমাবেশের আগের রাতে গতকাল শুক্রবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে পুলিশের ওপর হামলার পরিকল্পনা ও উসকানির অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে ডিবি। এ পর্যন্ত বিএনপির প্রায় পাঁচ শ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এর আগে রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। শুক্রবার বিকেলে এ ঘোষণা আসার পর থেকে মাঠে বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা আসতে থাকেন। সন্ধ্যা নাগাদ মাঠের একাংশ ভরে যায়। গোলাপবাগ মাঠে শনিবার বেলা ১১টায় বিএনপির সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘কাল বেলা ১১টায় সমাবেশ শুরু হবে। গোলাপবাগে মঞ্চ তৈরি, মাইক লাগানো এবং নিরাপত্তার জন্য পুলিশের সহযোগিতা চাই আমরা।’
প্রায় তিন মাস আগে বিএনপি ১০ বিভাগীয় শহরে গণসমাবেশ কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। ঢাকায় ১০ ডিসেম্বর গণসমাবেশ করতে নয়াপল্টনের জন্য অনুমতি চেয়ে গত ১৩ নভেম্বর ও ২০ নভেম্বর ডিএমপি কমিশনারের কাছে লিখিত আবেদন করেছিল বিএনপি। বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে চায়। কিন্তু ডিএমপি বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে বলে।
এই বিতর্কের মধ্যেই ৭ ডিসেম্বর দলীয় অফিসের সামনে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে একজন নিহত হন। এরপর পুলিশ দলীয় অফিসে অভিযান চালিয়ে সেখানে অবস্থানরত সবাইকে গ্রেপ্তার করে এবং অফিস তালা ঝুলিয়ে দেয়। এখন প্রশ্ন এই সংঘাত ও গ্রেপ্তার কি এড়ানো যেত না?
বিএনপির সমাবেশের স্থান নিয়ে বিতর্ক চলাকালে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তল্লাশিচৌকি বসিয়েছে সরকার। দূরপাল্লার প্রতিটি বাস থামিয়ে দেখছেন। কেবল বাস নয়, অটো মাইক্রো ও ব্যক্তিগত গাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়েছে। পরিবহনমালিকেরা বলেছেন, ঢাকায় বাস চলাচল সীমিত করে দেওয়া হয়েছে। আগের সমাবেশগুলোতে ছিল পরিবহন ধর্মঘট। এবার পরিবহন রেশনিং।
আওয়ামী লীগের নেতাদের ভাষায় বিএনপির মতো একটি ‘দুর্বল দলের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকার ও সরকারি দল গত কয়েক দিন ধরে যেই তৎপরতা চালিয়েছে, তাতে নিজেদের দুর্বলতাই প্রকাশ পেয়েছে। বিএনপির সমাবেশ উপলক্ষে পাড়ায় পাড়ায় আওয়ামী লীগ নেতারা কেন পাহারা দেবেন?বসরকার যেভাবেই ক্ষমতায় আসুক না কেন, পাহারার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। পাহারার দায়িত্ব জনপ্রশাসনের। সেই দায়িত্ব কোনো দলের নেতা-কর্মীরা নিলে সরকারের প্রয়োজন কী?
বিএনপির সমাবেশ সামনে রেখে যেমন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পাহারা বসিয়েছেন, বিএনপির নেতা-কর্মীরা একইভাবে পাহারা বসালে দেশের কী পরিস্থিতি তৈরি হবে, তা–ও নেতা-নেত্রীদের ভাবা উচিত। একটি অন্যায়ের প্রতিকার আরেকটি অন্যায় দিয়ে হতে পারে না।
এই যে কয়েক দিন ধরে দেশে একটা অস্থির অবস্থা চলছে, এতে রাজনীতিকদের কিছু না হলেও সাধারণ মানুষ, শ্রমজীবী মানুষ ভীষণ উৎকণ্ঠায় আছে। তাঁদের বৃহত্তর অংশ কোথায় কার সম্মেলন বা সমাবেশ হলো, তা নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নন। তাঁরা চান তাঁদের জীবিকা যেন বন্ধ না হয়। যেদিন কাজ বন্ধ থাকবে, সেদিন না খেয়ে থাকতে হবে। ক্ষমতার রাজনীতি এই মানুষগুলোকে নিয়ে ভাবে না।
বাধা দিচ্ছে না পুলিশ
ঢাকার সায়েদাবাদের গোলাপবাগ মাঠে বিভিন্ন এলাকা থেকে বিএনপির গণসমাবেশে আসছেন নেতা-কর্মীরা। সমাবেশস্থল ঘিরে সাঁজোয়া যান, জলকামানসহ বহু পুলিশ সদস্য অবস্থান নিয়েছেন। তবে সমাবেশে প্রবেশ করতে নেতা-কর্মীদের বাধা দিচ্ছেন না পুলিশ সদস্যরা।
সমাবেশস্থলের আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সমাবেশস্থলের চারপাশে প্রচুর পুলিশ সদস্যরা অবস্থান নিয়েছেন। কমলাপুর, যাত্রাবাড়ী এলাকায় সড়কের একপাশ ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। সাঁজোয়া যান, জলকামান নিয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। তবে সমাবেশস্থলে ঢুকতে কাউকে বাধা দেওয়া হচ্ছে না।
নয়াপল্টনের নাইটিঙ্গেল মোড়ে আজ সকালে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘বিএনপির সমাবেশ করা মৌলিক অধিকার। আমরা অনুমতি দিয়েছি, সেখানে তো কোনো অবৈধ জমায়েত হচ্ছে না। আমাদের ২০ হাজার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সেখানে কাজ করছেন।’
রাজধানীতে গণপরিবহন কম চলাচলের কারণ জানতে চাইলে হারুন অর রশীদ বলেন, আজ এমনিতেই ছুটির দিন। যাঁদের কাজ নেই, তাঁরা বের হচ্ছেন না। এ জন্যও চাপ কম। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক। দুই দিন আগে যেহেতু একটি ঘটনা ঘটেছে, মানুষজন খুব একটা বের হচ্ছেন না।
নয়াপল্টন এলাকা পুলিশের নিয়ন্ত্রণে থাকা ও চলাচল বন্ধ কি না জানতে চাইলে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন আপনারা চাইলে ওদিকে যেতে পারবেন।’
ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া ছাত্রলীগ
বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে ছাত্রলীগ৷ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম এই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাসের প্রবেশমুখসহ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোয় অবস্থান করছেন।
ক্যাম্পাসের অন্যতম প্রবেশমুখ নীলক্ষেতের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণের সামনে থেকে মুঠোফোন ঘেঁটে বিএনপি-সমর্থক ১০-১২ জনকে মারধর করে পুলিশে দিয়েছে বলে জানিয়েছে ছাত্রলীগ।
আজ শনিবার সকালে ও দুপুরে দুই দফায় বিএনপি সমর্থক সন্দেহে ১০-১২ জনকে নীলক্ষেতের তোরণের সামনে আটক করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। মারধর ও মুঠোফোন ঘাঁটার পর তাঁদের পুলিশের হাতে তুলে দেন তাঁরা।
নীলক্ষেতে অবস্থান নেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘দুই দফায় ১০-১২ জনকে আমরা পুলিশে দিয়েছি। তাঁদের মুঠোফোন চেক করে বিএনপি সমর্থক বলে নিশ্চিত হয়েই শাহবাগ থানা-পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি ও ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা নাশকতার পরিকল্পনা নিয়ে ঢাকায় এসেছে। এসব সন্ত্রাসীকে রুখতে ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ আছে। আমরা বিএনপি-জামায়াতের অশুভ রাজনীতির কবর রচনা করবই।’
কিন্তু এখানে প্রশ্ন ছাত্রলীগকে নাগরিকদের মুঠোফন চেক করার অধিকার কে দিয়েছে! কেনই বা আওয়ামী লীগ পুলিশের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিচ্ছে! তাদের কীসের এতো ভয়? আওয়ামী লীগের প্রবল প্রতাপ ও একতরফা শাসনে কোণঠাসা বিএনপি গত ১৩ বছরে সেই অর্থে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিই পালন করতে পারেনি। সরকারের দমন-পীড়ন ও মামলায় বিপর্যস্ত বিএনপি মাথা তুলে দাঁড়ানোর সুযোগ পায়নি। আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি বারবার ধরা খেয়েছে। সেই বিএনপির জনসমাবেশে এতো লোকসমাগম দলটিকে আত্মবিশ্বাস জোগাচ্ছে। আওয়ামী লীগ শুধু ক্ষমতাসীন দল নয়, ১৩ বছরের বেশি সময় ধরে তারা বাংলাদেশে নিজেদের একচ্ছত্র রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে গেছে। আর এই একনায়কতন্ত্রের বেলুনের দিকে কি তবে আলপিন হয়ে এগিয়ে আসছে বিএনপি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৫০
আপনার মতামত জানানঃ