প্রযুক্তির ধারাবাহিকতায় মানুষের যৌন জীবনেও এসেছে পরিবর্তন। বিশ্ববাজারে বিভিন্ন দেশে এখন প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে সেক্স রোবট ও যৌন সামগ্রি। এর ফলে মানুষের রুচির পরিবর্তন আসছে। বেশ কয়েক বছর আগেও সেক্স রোবট ছিল নিশ্চল। কিন্তু প্রযুক্তির কল্যাণে বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন সেক্স রোবট বাজারে এসেছে।
এসব রোবট যেমন আবেদনময়ী, তেমনি মানুষের মতোই আচরণ করতে পারে। তারা কথা বলতে পারে এবং বিশেষ করে যৌনসঙ্গী হিসেবে কাজ করে। আর সেটা নিয়েই বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন এসব সেক্স রোবট মানুষের মনে এবং সমাজে মানবিক যৌনতার ব্যাপারে একেবারে উল্টো ধারণা গড়ে দিতে পারে। যা সমাজের টিকে থাকার প্রশ্নে বেশ উদ্বেগের।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এসব রোবটকে মানুষের সঙ্গিনীর সমকক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। যা একেবারেই খারাপ চিন্তা। যারা এ ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন সেক্স রোবট তৈরি করে বাজারজাত করছে, তাদের আরো অনেকটা দায়িত্বশীল হওয়া দরকার এবং নৈতিকতার দিকটি বিবেচনায় রাখা উচিত। সেই সঙ্গে কিছু নিয়ম নীতি না থাকলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের শঙ্কার কথাও বলছেন তারা।
নর্থ ক্যারোলিনার ডিউক ইউনিভার্সিটির গবেষক ড. ক্রিস্টিন হেনড্রেন বলেন, জাপানের সেক্স রোবট প্রস্তুতকারকদের একজন স্বীকার করেছেন, এসব রোবটের কারণে তিনি সন্তানের ব্যাপারে আগ্রহী নন। এ ধরনের চিন্তা বাড়তে থাকলে সমাজ বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ ধরনের পণ্য বাজারে ছড়িয়ে পড়লে এবং মানুষ তাদের দ্বারা যৌন চাহিদা পূরণ করতে থাকলে একপর্যায়ে অন্য অনেক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রোবটকে মানুষের সমকক্ষ হিসেবে ভাবার শঙ্কা রয়েছে।
ইংল্যান্ডের গবেষক ক্যাথলিন রিচার্ডসন বলেন, আন্তরিকতা, পারস্পরিক সম্পর্ক, বিশ্বাস এবং আইনের মাধ্যমে দুজনের দাম্পত্য জীবন শুরু হয়। কিন্তু কোনো যন্ত্র তো এসব ধাপ পার করে সম্পর্কে জড়ায় না।
তিনি আরো বলেন, যারা চাইলেই রোবটের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে জড়াতে পারেন। তাদের কাছে নারীরা কেবল ওইসব রোবটের সমকক্ষ। সে ক্ষেত্রে নারীদের কেবল যৌনসঙ্গী হিসেবে ভাবার শঙ্কা রয়েছে। আর এরকম চিন্তা বাড়তে থাকলে সমাজ এগিয়ে যাবে ধ্বংসের দিকে।
প্রযুক্তিবিদরা ভয়ংকর এই বিপদ সংকেত দিয়েছেন বেশ আগেই। তারা বলেছেন, এই ধারা চলতে থাকলে সেক্স রোবট পুরো মানবতাকে চিরদিনের জন্য পাল্টে দিতে পারে। কারণ, এর ফলে মানুষের যৌন চাহিদা মেটানো অধিকতর সহজ হয়ে পড়বে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সমাজে।
কম্পিউটার বিজ্ঞানী নোয়েল শারকি এমন সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। সেক্স রোবট সমাজে এমন পরিণতি ডেকে আনবে এমন সতর্কবাণী সত্ত্বেও কিন্তু বাজারে ক্রমবর্ধমান হারে এর চাহিদা বাড়ছে।
তিনি সতর্ক করেন, সেক্স রোবটের যেভাবে চাহিদা বাড়ছে তাতে সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। কারণ, মানুষের মানবিক, জৈবিক চাহিদা পূরণ খুব সহজ হয়ে যাবে। তখন একজন নারীকে একজন পুরুষের প্রতি বা একজন পুরুষকে একজন নারীর প্রতি আবিষ্ট হতে দেখা যাবে না।
২০১৭ সালের এক গবেষণায় বলা হয়, কিছুদিনের মধ্যে চার ভাগের এক ভাগ মানুষ রোবটের সঙ্গে তার যৌন সম্পর্ক গড়ে তাতেই তৃপ্তি মেটাবে। প্যারিসভিত্তিক মিডিয়া প্রতিষ্ঠান হাভাস থেকে এ বিষয়ে জরিপ করা হয়। তাতে দেখা যায়, ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সসীমার মধ্যে শতকরা ২৭ ভাগ মানুষ এমন সম্পর্ককে বেছে নেবে। এতে আরো বলা হয়, নারীদের তুলনায় এমন সম্পর্কে তিনগুন বেশি আগ্রহী পুরুষরা।
এদিকে, লিনৎস প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে রোবট মনস্তত্ববিদ মার্টিনা মারা মনে করেন, এর ফলে প্রকৃত সম্পর্কে সমস্যা হতে পারে৷ তিনি বলেন, ‘‘বর্তমানে বাজারে যে সেক্স রোবট রয়েছে, সেগুলির মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশ নারীদের সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার প্রতিফলন ঘটায়৷ অর্থাৎ, নারী মানেই পরোক্ষ ভূমিকা পালন করবে৷ একদিকে মানুষ, অর্থাৎ নারীর শরীরকে বস্তু হিসেবে আরো তীব্রভাবে তুলে ধরা হচ্ছে৷ অন্যদিকে রোবটের মাধ্যমে নারী ও পুরুষের পার্থক্য সম্পর্কে বদ্ধমূল ধারণাগুলি আসল সম্পর্কের উপরেও প্রভাব রাখছে৷”
সেক্স রোবট কিন্তু কাজেও লাগতে পারে৷ ‘ফাউন্ডেশন ফর রেসপন্সিবল রোবটিক্স’ এর মাধ্যমে সেই সব মানুষের থেরাপির সম্ভাবনা দেখছে, যৌনতা নিয়ে যাদের সমস্যা রয়েছে৷ এথিক্সের অধ্যাপক টোমাস বেশরর্মার এমনকি মনে করেন যে, সেক্স রোবটদের প্রতি আমাদের মনে প্রকৃত অনুভূতি জাগতে পারে৷ টোমাস বলেন, ‘‘এইসব যন্ত্রের সঙ্গে দ্রুত ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠবে বলে আমার জোরালো অনুমান রয়েছে৷ এমন রোবটের মালিক দ্রুত তার নাম রাখবে৷”
তবে বাস্তবধর্মী সেক্স রোবট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রিয়েলডলের মতে, তাদের তৈরি সেক্স ডলগুলো বহু নিঃসঙ্গ মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির এক মুখপাত্র জানান, সেক্স রোবটগুলোকে এখনও মানুষ যৌনসঙ্গী হিসেবেই বেশি ব্যবহার করছে। তবে আমাদের এমন অনেক ক্রেতা আছেন যারা এটিকে বিয়ে করছেন। তারা জানিয়েছেন এসব সেক্স রোবট তাদের জীবন বাঁচিয়েছে, কেননা সঙ্গী মারা যাওয়ার পর বা কোন সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে সেক্স রোবটই তাদের বেঁচে থাকা অনুপ্রেরণা জোগায়।
এর মাঝেই জার্মানিতে চালু হয়েছে সেক্স রোবট দিয়ে প্রথম পতিতালয়। জার্মানি ও অস্ট্রিয়াতে পতিতালয়গুলোতে সেক্স রোবট ব্যবহারের বৈধতা রয়েছে। জার্মানির প্রতি ৫ জনের একজন বলেছে, তারা সেক্স রোবটে আগ্রহী।
এছাড়া জাপানেও রয়েছে সেক্স ডলের পতিতালয়। বার্লিনে আছে, সেক্স ডল এসকর্ট সার্ভিস। পতিতালয়ে থাকা এ পুতুলগুলো সিলিকন দিয়ে তৈরি।
জার্মানির এমন এক পুতুল পতিতালয়ে আছে সিলিকনের তৈরি ১২টি পুতুল। এই ১২টি পুতুলের মধ্যে একটি পুরুষ। আর একটি পুতুলের স্তন ও পুরুষাঙ্গ দুটিই আছে। ঘণ্টায় ৮০ ইউরো খরচ করে এমন একটি ঘরে আগ্রহীরা তাদের যৌনাকাঙ্ক্ষা মেটাতে পারেন।
এমন একটি পতিতালয় বোরডলের প্রতিষ্ঠাতা ৩০ বছর বয়সী এভিলিন শোয়ার্ৎস। তিনি যখন একটি পতিতালয় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তখন জার্মান ভাষাভাষী যৌনকর্মী জোগাড় করতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। পরে জাপানের একটি পুতুল পতিতালয়ের মডেল দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে এ পুতুল পতিতালয় তৈরি করেন তিনি।
চীন থেকে এসব পুতুল আনেন এভলিন শোয়ার্ৎস। যার একেকটিতে খরচ পড়েছে এক থেকে দুই হাজার ইউরো। একেকটা পুতুল ৬ মাস পর্যন্ত সেবা দিতে পারে। এভলিনের একজন সহকারী আছেন যিনি পুতুলগুলো পরিষ্কার করেন।
পুতুলগুলোর মাধ্যমে যাতে কোনো রোগ না ছড়ায় তার জন্য যত্ন নেয়া হয়। প্রতিদিন ৫ থেকে ১২ জন খদ্দের আসেন এই পুতুল পতিতালয়ে। শুধু এসব সিলিকন পুতুলই নয়, বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবটের কথাও ভাবা হচ্ছে যৌনকাজে ব্যবহারের জন্য।
এসডব্লিউএসএস/১৫২৫
আপনার মতামত জানানঃ
![Donate](https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/06/xcard.jpg.pagespeed.ic.qcUrAxHADa.jpg)
আপনার মতামত জানানঃ