মানুষ নিয়ে পৃথিবীতে যত ঘৃণ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়েছে তার মধ্যে ইউনিট ৭৩১ সম্ভবত সবচেয়ে বেশি জঘন্য এবং ভয়ংকর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের খলনায়ক হিসেবে সবসময়েই জার্মানির নাম নেয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রেই বলা হয় রাশিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রের ঋণাত্মক ভূমিকার কথা। জাপানের নাম সেখানে খুব কমই নেয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই জাপানেই গড়ে উঠেছিল ভয়ানক ইউনিট ৭৩১ নামে এক ক্যাম্প, যেখানে যুদ্ধবন্দী ও অন্যান্য সাধারণ নাগরিকদের নিয়ে চালানো হত অমানুষিক পরীক্ষা।
১৯৩১ সালে ইম্পেরিয়াল জাপানিজ আর্মি মাঞ্চুরিয়ায় আক্রমণ চালায়। এরপরই জাপানের সামরিক কর্মকর্তারা জায়গাটিকে বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল ও কেমিকেল ওয়েপনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে মনে করা শুরু করেন। এ লক্ষ্যে হার্বিনে গোপন একটি ল্যাবরেটরিও গড়ে তোলা হয়। ইউনিট ৭৩১ প্রতিষ্ঠার পথে এটিই ছিলো প্রথম পদক্ষেপ। কিন্তু এ প্রচেষ্টাটি সফল হয় নি। কারণ বেশ কিছু বন্দী সেখানে বিষ্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম হয়। ফলে অবস্থান পরিবর্তনে বাধ্য হন ইশী।
আর কয়েক বছর পরই দুনিয়ার ভেতর এক টুকরো জাহান্নাম হতে যাওয়া ইউনিট ৭৩১ জনগণের কাছে তখন পর্যন্ত বেশ চমৎকার এক নামেই পরিচিত ছিলো- ‘Epidemic Prevention and Water Supply Unit of the Kwantung Army’। এমন নাম দেখে কেউ সন্দেহই করবে না যে এর হর্তাকর্তাদের মাথায় কী খেলা করছে। ১৯৩৬ সালের ১ আগস্ট সার্জন জেনারেল শিরো ইশীর হাতে এই ইউনিটের দায়িত্ব অর্পন করা হয়। পিংফ্যানে অবস্থিত প্রায় ছয় বর্গ কিলোমিটারের সেই স্থাপনাটি চারদিকে উঁচু দেয়াল আর কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা ছিলো। ভেতরে প্রায় দেড়শ’র মতো বাড়ি ছিলো। এর মাঝেই বন্দীদের থাকার জায়গা, চুল্লী, পশু রাখার স্থান এবং এয়ার ফিল্ড ছিলো। ৭ ও ৮ নাম্বার ব্লক দুটোতে চলতো ব্যাকটেরিয়ার উৎপাদন ও গবেষণা।
কাজকর্মের সুবিধার্থে পুরো ইউনিট ৭৩১-কে ৮টি আলাদা ডিভিশনে বিভক্ত করা হয়েছিলো। ইউনিটটির গোপনীয়তা রক্ষা করার ব্যাপারে এর কর্মকর্তাগণ সদা সতর্ক নজর রাখতেন। এতে যারা কাজ করতো, তাদের আনা-নেয়ার কাজে ব্যবহৃত কার্গো ট্রাকগুলো সবসময় ঢাকা থাকতো। এছাড়া সেগুলোর রেজিস্ট্রেশন ট্যাগও নিয়মিত পরিবর্তন করা হতো। একসময় পিংফ্যানে অবস্থিত এই ইউনিটটিতে ৩০০ কেজির মতো প্লেগের জীবাণুও প্রস্তুত করা হচ্ছিলো নিয়মিত! অবস্থা এমন হয় যে, পুরো মানবজাতিকে কয়েকবার সাফ করে দেয়ার মতো জীবাণু তৈরির সক্ষমতাও অর্জন করেছিলো তারা।
সার্জন জেনারেল ইশী যে ঠিক কী বিষয় নিয়ে সেখানে গবেষণা করতেন, তা জানা ছিলো না তার সহকর্মীদেরও। বন্দীদের দলে দলে ঢোকানো হতো ‘ডেথ ব্লক’ খ্যাত ব্লক ৭ ও ৮ এ। সেখানে একবার ঢুকলে আর ফিরে আসার কথা ভাবা যেত না, নিশ্চয়তা ছিলো কেবলই মৃত্যুর!
মাঞ্চুরিয়ার এমন দূরবর্তী এলাকায় ইউনিটটি স্থাপনের পরিকল্পনাও ছিলো ইশীর। কারণ তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে সরাসরি মানুষের উপরই গবেষণা করতে চেয়েছিলেন। তার গবেষণায় প্রাণ দেয়া মানুষদের অধিকাংশই আসতো পিংফ্যানের হগোইন নামক বন্দীশিবির থেকে। যেসব রাশিয়ান নাগরিক কোনো তথ্য দিয়ে সহায়তা করতো না, তাদেরকে সরাসরি পাঠিয়ে দেয়া হতো সেখানে। তবে বন্দীদের প্রায় সত্তর ভাগই ছিলো চীনের নাগরিক। নিরীহ লোকগুলোকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে সেখানে আনা হতো। কারো কারো ক্ষেত্রে কাজ করতো চাকরি দেবার প্রলোভন। শিশু-কিশোর, এমনকি গর্ভবতী নারীরাও বাদ যায় নি এ ফাঁদে পড়াদের তালিকা থেকে।
যদি কেউ একবার স্বচক্ষে সেখানকার অবস্থা দেখতো, তবে সে নির্ঘাত সেটাকে কোনো দুঃস্বপ্ন বলেই মনে করতো। ইস্পাতের দরজায় গোল করে কাটা ছিদ্র দিয়ে দেখা যেত শিকলে আটকানো বন্দীদের। তাদের কারো কারো শরীরে পচন দেখা যেত, কারো আবার পচা মাংসের মাঝ দিয়ে উঁকি দিতো হাড়! মারাত্মক জ্বর আর ব্যথায় ভুগতে থাকা কেউ হয়তো যন্ত্রণায় গোঁ গোঁ করতে থাকতো। শ্বসনযন্ত্রের সমস্যায় ভোগা কেউ আবার কাশতে কাশতে যেন দেহ থেকে পারলে আত্মাটাকেই বের করে দিতো। কারো শরীর ফুলে গিয়েছিলো, কেউ বা ছিলো অতিরিক্ত রোগা, কেউ কেউ আবার চুপচাপ শুয়ে-বসে থাকতো গা ভর্তি ফোস্কা নিয়ে। একজন রোগাক্রান্ত বন্দীকে আরেকজন নিরোগ বন্দীর সংস্পর্শে রেখে দেখা হতো রোগ কতটা দ্রুত ছড়াতে পারে। নারী বন্দীদেরকে সেখানকার প্রহরীরা রুটিনমাফিক ধর্ষণ করতো। ওদিকে চিকিৎসকেরা গ্যাস চেম্বার, খাবার, পানীয় ইত্যাদির মাধ্যমে বন্দীদের মাঝে নানা রোগের জীবাণু ছড়িয়ে দিতো।
যুদ্ধ চলাকালে জাপানী সেনাদের শারীরিক বিভিন্ন আঘাত সম্পর্কে গবেষণা করতে বেছে নেয়া হতো বিভিন্ন বন্দীকে। এদের মাঝে ছিলো জাপানী সেনাদের হাতে ধরা পড়া মিত্র বাহিনীর সদস্য এবং চীন ও রাশিয়ার সাধারণ নাগরিকেরা। ধরে এনে হয়তো তাদের কোনো অঙ্গ কেটে দেয়া হতো রক্তক্ষরণ নিয়ে গবেষণার জন্য। কিছু কিছু পরীক্ষার আবার যুদ্ধের সাথে কোনো সম্পর্কই ছিলো না।
যেমন কখনো কখনো একজন বন্দীর শরীরের একটি অঙ্গ কেটে তা আরেক জায়গায় লাগিয়ে দেয়া হতো। কখনো তার শরীরকে ঠান্ডা করে একের পর এক কাটা হতে থাকতো হাত-পাগুলো!
১৯৩৭ সালের ডিসেম্বরে চীনের রাজধানীতে প্রবেশ করে জাপানী সেনারা। এরপর তারা সেখানকার জনগণের সাথে হত্যা-ধর্ষণের যে লীলাখেলায় মেতে উঠেছিলো, এর সাথে বোধহয় শুধুমাত্র চেঙ্গিস খানের মোঙ্গল বাহিনীরই তুলনা দেয়া চলে। বন্দী কাউকেই ছাড় দেয়া হয় নি। অমানবিক নির্যাতন, পানিতে ডুবিয়ে মারা, শিরোশ্ছেদ, লুন্ঠন, ধর্ষণ, জোরপূর্বক ইনসেস্টে বাধ্য করার মতো অগণিত ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছিলো জাপানী সেনারা।
একবার ইউনিট ৭৩১ এর দুজন অফিসারের মাঝে প্রতিযোগীতা হয়েছিলো কে আগে তাদের হাতে থাকা তলোয়ারের সাহায্যে বন্দী হত্যার সেঞ্চুরি করতে পারবে। কে যে করতে পেরেছিলো তা জানা না গেলেও যুদ্ধ পরবর্তীকালীন সময়ে ইউনিট ৭৩১ এর অনেক কর্মকর্তার মতো তাদেরও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
এখানকার ১ম ডিভিশনে বিউবোনিক প্লেগ, কলেরা, অ্যানথ্রাক্স, টাইফয়েড, যক্ষার মতো ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ নিয়ে গবেষণা করা হতো। রোগগুলোর জীবাণু আগে এই বন্দীদের দেহেই প্রবেশ করানো হতো। এরপর তাদের নিয়ে চলতো গবেষণা। অনেক বন্দীই এর ফলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল।
সিফিলিস ও গনোরিয়ার মতো রোগগুলো নিয়ে গবেষণার জন্য বেছে নেয়া হতো একজন নারী ও একজন পুরুষকে, যাদের একজন রোগটিতে আক্রান্ত থাকতো। এরপর গুলি করার হুমকি দিয়ে তাদেরকে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করা হতো।পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা নজর দিতো এদের মিলনের ফলে জন্ম নেয়া সন্তানটির দিকে। সেই সন্তানটির শরীরে রোগটির প্রভাব কেমন এবং তা মায়ের প্রজনন তন্ত্রেই বা কেমন প্রভাব ফেলে তা নিয়ে চলতো গবেষণা। এভাবে যে কতগুলো শিশু জন্ম নিয়েছিলো তা জানা যায় না। তবে ১৯৪৫ সালে যখন ইউনিটটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়, তখন তাদের কেউই জীবিত ছিলো না।
ছয় বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত বিশালাকার এ ইউনিটে ছিলো অসংখ্য ভবন। এগুলোর একেকটি একেক কাজে ব্যবহার করা হতো। এর মাঝে একটিতে বড় করা হচ্ছিলো প্লেগের জীবাণুবাহী মাছি। একই জায়গায় প্যাথোজেনের কালচারও করা হচ্ছিলো। বিশালাকার একটি সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প বানানো হয়েছিলো শুধু এটা পরীক্ষা করতে যে, মানুষকে মারতে কী পরিমাণ শক্তির দরকার। হাই প্রেশার চেম্বারগুলোতে বন্দীদের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসতো। গর্ভবতী নারীদের জোর করে অ্যাবরশন করানো হতো। তাদেরকে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকগুণ বেশি এক্স-রে’র মাঝে রাখা হতো, যা পরবর্তীতে হতো তাদের মৃত্যুর কারণ।
এমনকি মা ও সন্তানের ভালোবাসাও রেহাই পায় নি বিজ্ঞানীদের পরীক্ষার হাত থেকে। এক পরীক্ষায় রাশিয়ান মা ও তার সন্তানকে একটি কক্ষে বন্দী করে সেখানে বিষাক্ত গ্যাস প্রবেশ করানো হতে থাকে। বিজ্ঞানীরা দেখতে চেয়েছিলেন মা ও সন্তানের এ ভালোবাসা কতটা গাঢ় হতে পারে। সন্তানকে বাঁচাতে মা তাকে কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারেন নি তিনি, মৃত্যু হয় দুজনেরই।
বিভিন্ন অস্ত্রের পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করা হতো ইউনিট ৭৩১ এ আনা বন্দীদের। প্রথমে তাদেরকে কোনো খুঁটির সাথে বাঁধা হতো। এরপর সবাই মিলে তাদের দিকে প্লেগের জীবাণু ছড়ানোর বোম নিক্ষেপ করতো, বন্দুকের নিশানা প্র্যাকটিস করতো কিংবা গ্রেনেড ছুড়ে মারতো।
শিরো ইশীর তত্ত্বাবধানে অ্যানথ্রাক্স, কলেরা, টাইফয়েড ও বিউবোনিক প্লেগের জীবাণুযুক্ত বোম নিক্ষেপ করা হতো বন্দীদের উপর। এছাড়া তিনি পোর্সেলিন শেলের এমন একটি বোমের ডিজাইন করেছিলেন যাতে থাকতো রোগের জীবাণুবাহী মাছি। সেই মাছিগুলো আরো বেশি এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়তো আর খুঁটিতে বাঁধা বন্দীদের শরীরে গিয়ে বসতো। পরবর্তীতে নিরাপত্তামূলক স্যুট পরিধান করে ইউনিটের ডাক্তাররা তাদের পরীক্ষা করতেন।
জীবিতাবস্থায় কোনো কোনো বন্দীর পাকস্থলী কেটে নেয়া হতো। কখনো কখনো তাদের উল্টো করে ঝুলিয়ে রেখে দেয়া হতো যতক্ষণ না তারা মারা যায়। এভাবে একজন মানুষ কতক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে সেই সময়টা বের করাই ছিলো এমন নির্যাতনের মূল উদ্দেশ্য। কোনো কোনো বন্দীর কিডনীতে সিরিঞ্জের সাহায্যে ঘোড়ার মূত্র প্রবেশ করানো হতো।
জানা যায়, সার্জন জেনারেল শিরো ইশীর নেতৃত্বাধীন এই ইউনিট ৭৩১ এর ল্যাবরেটরিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় তিন হাজার মানুষ। অন্যদিকে ফিল্ড এক্সপেরিমেন্টে প্রাণ হারায় আরো প্রায় দশ হাজারের মতো মানুষ।
এসডব্লিউএসএস/২০০০
আপনার মতামত জানানঃ