আজকের দিনে সামান্য বস্তুতে পরিণত হওয়া সুইয়ের আছে প্রাচীনতম এবং গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। প্রত্নতত্ত্ববিদ এলিজাবেথ অয়েল্যান্ড বারবারার মতে সুই শিল্প বিপ্লবের একেবারে আদি বিকাশে টিকে থাকা একটি অনুষঙ্গ; যেটাকে তিনি বলছেন ‘স্ট্রিং রেভ্যুলেশন’।
প্রাগৈতিহাসিক সময়ে মানুষের টিকে থাকার লড়াইয়ের সাথে সাথে নিতান্ত প্রয়োজনে যে শিল্পটি গড়ে উঠেছিল তা হল সূচিশিল্প। সুই আর সুতোর সম্মিলনে এই শিল্প ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল। আধুনিক সভ্যতার বিকাশে এই শিল্পের ভূমিকা যদিও আমরা অনুভব করতে পারি না, কিন্তু সুই-সুতোর কাজ হাজার বছরের পুরনো এক শিল্প।
এই শিল্পের বয়স কম করে হলেও বিশ হাজার বছরের পুরোনো আর এর মূল অনুষঙ্গ সুইয়ের রয়েছে আরও পুরনো ইতিহাস। কোন লিখিত প্রমাণ না পাওয়া গেলেও ধারণা করা হয় চল্লিশ হাজার বছর পুরনো প্রাচীন-প্রস্তর যুগে অর্থাৎ প্যালিওলিথিক সময়েও সুইয়ের ব্যবহার ছিল।
প্রাচীন প্রস্তর যুগে মানুষের জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা না গেলেও বৈরি আবহাওয়া ও প্রকৃতিতে নিরন্তর সংগ্রাম করে জীবন ধারণ করতে হয়েছে। তাদের জীবন সহজ ছিল না। পশু শিকার ছিল একমাত্র কাজ। পশুর চামড়া থেকে শীত নিবারণের উদ্দেশ্যেই প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ প্রাণীর হাড়, হরিণের শিং কিংবা হাতির দাঁত থেকে সুই তৈরি করতে শেখে। সে সময়কার সুইয়ে ফুটোর জায়গায় ছিল খাজ কাটা যেখানে পশুর কোন পেশিতন্তু শুকিয়ে বা গাছের আঁশ শুকিয়ে সূতো হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
পঁচিশ হাজার বছর পুরনো গ্রাভেটিয়ান সভ্যতায়ও ফুটোসহ সুইয়ের অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায়। এ সময়ে মানুষ মাছের কাটা, কাঠ এবং হাতির দাঁত দিয়ে সুই তৈরি করতো এবং সেগুলো ছিল ভারী এবং মোটা। অনেক সুইয়ের শেষ প্রান্তে বা মাঝখান ফুটো থাকলেও বেশির ভাগ সুইয়ের পিছন দিকে একটা বাকানো হুকের মত থাকত।
বরফ যুগের পর নতুন কোন জায়গায় বসতি স্থাপন করা ছিল সভ্যতার যাত্রায় কয়েক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। পশুর চামড়া সেলাই করে বস্ত্র হিসেবে পরিধান করার বুদ্ধি না হলে এ যাত্রায় অগ্রগতি কিছুতেই সম্ভব ছিল না। পশুর চামড়া সেলাই করতে সুই ছিল অন্যতম এক আবিস্কার। নতুন নতুন জায়গায় বসতি স্থাপন এবং সভ্যতার অগ্রযাত্রায় সুই এবং সেলাইয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শুধু প্রয়োজন মেটাতেই গ্রেভেটিয়ান যুগের মানুষ সুইয়ের ব্যবহার করেনি, তারা সামাজিক প্রয়োজনেই সুই ব্যবহার করেছে।
ব্রোঞ্জ যুগে সুইয়ের আকৃতিতে আসে আরও পরিবর্তন। বিভিন্ন জিনিস তৈরিতে তখন ধাতুর ব্যবহার শুরু হয়েছে। ধাতু দিয়ে ছোট, বড় বিভিন্ন আকৃতির সুই তৈরি হয় এ সময়ে। গ্রীসে তখন বড় সুই দিয়ে নারীদের দীর্ঘ পোশাকের ঝুল সেলাই করা হত। লৌহ যুগে রোমানরা লোহা এবং হাতির দাঁতের সুই ব্যবহার করতো। তখন রুপার তৈরি সুইও ব্যবহৃত হত বিভিন্ন রাজকীয় কাজে। ব্রোঞ্জ যুগে বসবাসকারী পেরুর অধিবাসীদের সমাধীতে রূপার তৈরি সুই পাওয়া গেছে।
খুব সম্প্রতি আবিষ্কৃত রেড ইন্ডিয়ান এবং অন্যান্য আদিবাসীদের ডেরায় পাখির ডানার হাড়ের তৈরি সুই আবিস্কৃত হয়েছে। অর্থাৎ পাখির পাতলা হাড়কেও কোন কোন জাতি সুই হিসেবে ব্যবহার করেছে। শীতকালে পশুর চামড়া সেলাই করে পরার জন্য পশুর পেশীতন্তু শুকিয়ে সুতো বানিয়ে সুইয়ে ব্যবহার করা হতো। এখনো জিপসী সম্প্রদায়ের মধ্যে কাটাকে তেলের মধ্যে সিদ্ধ করে শক্ত বানিয়ে সুই হিসেবে ব্যবহার করার রীতি প্রচলিত আছে।
প্রাচীন মিশরে দুই ফুটো বিশিষ্ট ধারালো সুইয়ের ব্যবহার ছিল। প্রত্নতত্ববিদ হেনরিখ শ্লিম্যান “ট্রয়” এ ছয়টি হাড়ের তৈরি সুই খুঁজে পেয়েছিলেন। সবগুলোর খাঁজকাটা ছিল কিন্তু তার মধ্যে একটা ছিল চোখ বিশিষ্ট, এর মানে ট্রয় সাম্রাজ্যে সুই সুতোর ব্যবহার ছিল। রোমান সাম্রাজ্যে প্রাপ্ত সুই ছিল তামা আর লোহার তৈরি এবং সেগুলো ছিল চোখ বিশিষ্ট, মানে সুতো পরানোর জন্য ফুটো। অর্থাৎ প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা, গ্রীক সভ্যতা এবং রোমান সভ্যতা সবগুলোতেই সুই এবং সেলাইয়ের প্রচলন ছিল।
ধ্রুপদী যুগের শুরুতেও নকশা করা কাপড় পরার রীতি চালু ছিল। তখনো নারীরা সুই সুতো ব্যবহার করে বিভিন্ন নকশা ফুটিয়ে তুলতো কাপড়ে। গুপ্ত রাজত্বে সেলাই করা কাপড় জনপ্রিয় হয়ে উঠে। বৈদিক যুগ থেকে প্রচলিত উত্তরীয় ধীরে ধীরে নারীদের বিশেষ পোশাক ঘাগরায় রূপান্তরিত হয়। সিন্ধু উপত্যকায় নারীদের শুধু মাত্র নিচের অংশে কাপড় পরিধান করতে দেখা যেতো কিন্তু উপরের অংশ থাকত খোলা। যদিও ময়ূর সাম্রাজ্যের আগে থেকেই নারীরা উপরের অংশে সেলাই করা বস্ত্র পরিধানে অভ্যস্ত ছিল।
গুপ্ত আমল থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে মূলত সুই সুতার বহুল ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। সিন্ধু সভ্যতায় কাপড় সেলাই করে পরিধানের প্রচলন ছিল অর্থাৎ সুই সূতার ব্যবহার আমরা ভারতীয় প্রাচীন সভ্যতাতেও লক্ষ্য করি। অন্যদিকে নৃতত্ত্ববিদদের মতে চীনারা প্রথম উপযুক্ত স্টিলের সুই তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। যদিও অনেক গবেষক মনে করেন এর মূল উৎস ভারত।
সুইয়ের ইতিহাস ঘাটলে আমরা বুঝতে পারি কীভাবে পশ্চিমা বিশ্ব যান্ত্রিকভাবে বিশ্বকে পরিচালিত করেছে। যদিও ৩৫০০বছর আগে ভারতীয় চিকিৎসার ইতিহাসে সুইয়ের ব্যবহার সম্পর্কে জানা যায় কিন্তু এর মূল বিকাশ ঘটে আরবদের দ্বারা। এবং ইউরোপে এর বিকাশ ছিল অভাবনীয়। আরবরা যেহেতু ধাতব জিনিস তৈরি করতে জানতো তারা স্টিলের সুই তৈরির কৌশলও আবিষ্কার করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানেও আরবরা অন্যদের তুলনায় অনেক এগিয়ে ছিল। তারা শল্য চিকিৎসায় সুইয়ের ব্যবহার শুরু করে। আরব সাম্রাজ্য তখন বিস্তৃত অনেক দূর পর্যন্ত। স্পেনে তখন মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
স্পেন মুসলিমদের কাছ স্টিলের সুই তৈরির গোপন সুত্র জেনে নেয়। পরে অভিবাসিদের মাধ্যমে স্পেন থেকে তা ইংল্যন্ডে পৌঁছে। এমনকি অষ্টম হেনরির ( ১৫০৯-১৫৪৭) এর সময়েও লন্ডনে সুই তৈরির দক্ষতা জানে স্পেন থেকে আগত এক অভিবাসির কাছ থেকে। সুই সে সময়ে বিশেষ গুরুত্বের সাথে রাখা হত। গৃহস্থালি অন্যতম জরুরী জিনিস হিসেবে মহিলারা বিশেষ বাক্সে করে সুই রাখত।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিশেষ ভূমিকা পালনকারী আবুল কাশিম আল যাহাওয়ারি (৯৩৬-১০১৩) ছিলেন একজন দক্ষ সার্জন। তাঁকে বলা হতো পশ্চিমের আবাল্কাসিস। তাঁর লেখা বই “আল-তাশরিফ” শল্য চিকিৎসায় আজও গুরুত্বপুর্ণ। শল্য চিকিৎসায় তিনি বিভিন্ন প্রকারের সুই ব্যবহার করতেন। “আল-তাশরিফ” বইয়ে যাহাওয়ারি শল্য চিকিৎসায় বিভিন্ন প্রকার সুইয়ের বিস্তারিত ব্যবহার উল্লেখ করেছেন। সেই সুইগুলো ছিল স্টীলের তৈরি সোজা কিংবা বাঁকা সুঁই।
সুই তৈরির যে দক্ষতা আরবরা ইউরোপে এবং পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোতে নিয়ে গিয়েছিল যা তারা ১৬৫০ ক্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গোপন রেখেছিল তা ইংল্যান্ড শুরু করে সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে।
সুই উৎপাদনে উনবিংশ শতাব্দী ছিল শ্রেষ্ঠ সময়। নতুন নতুন মেশিনারি, সেলাই মেশিনের আবিস্কার, টেক্সটাইল শিল্পের বিকাশ, স্টীম জাহাজের কারণে বাণিজ্য বিস্তার, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ব্যপ্তির কারণে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় অন্যান্য শিল্পের সাথে সুই শিল্পেরও চাহিদা বেড়ে যায়, সাথে বেড়ে যায় উৎপাদন। সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান এর মতে ১৯০৬ এর মধ্যে শুধুমাত্র আমেরিকাতেই প্রতিদিন তিরিশ লক্ষাধিক সুই উৎপাদন হতো। আমেরিকায় বিক্রি হওয়া বেশির ভাগ সুই ইংল্যান্ডে তৈরি হতো।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে রেডিখ সুই-শিল্পের একেবারে উপরের দিকে অবস্থান করছিল। তারা বিশ্বের পুরো নব্বই ভাগ সুইয়ের চাহিদা পূরণ করতো। ধীরে ধীরে প্রতিযোগিতা বাড়তে থাকে। জার্মান সুই প্রস্তুতকারীরা ১৮৫০ এর দিকে কারিগরি দিক থেকে নেতৃত্বে চলে আসে। এসময়েই সুম্যাক কোম্পানি এক ধরনের মেশিন আবিষ্কার করে যা এক ধাক্কায় সুইয়ে সুতা পরানো যায়।
বর্তমান সময়েও জার্মান মেশিন-সুই প্রস্তুতকারীরা উৎপাদনে একেবারে প্রথম সারিতে অবস্থান করছে। মূলত বিশ্বজুড়ে বিশাল এক শিল্প গড়ে উঠেছে শুধুমাত্র এই একটা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অবহেলিত একটা অনুসঙ্গকে কেন্দ্র করে।
এসডব্লিউএসএস/০৯৪৫
আপনার মতামত জানানঃ