একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক। ২০১৬ সালের ২৬ জুন ঢাকার মিরপুর মধ্য পাইকপাড়ার হাবিবুর রহমানের বাড়িতে সশস্ত্র হামলা হয় বলে অভিযোগ৷ ওই ঘটনায় ২৩ জনের নাম উল্লেখ করে ২৯ জনকে আসামি করে মিরপুর থানায় মামলা হয়৷ কিন্তু মামলায় ১২ নম্বর আসামি আরিফুর রহমান ঘটনার অনেক আগেই মারা যান৷ আর ১৯ নম্বর আসামি রুবেলের বয়স এক বছরের কম৷ কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, মিরপুর মডেল থানার পুলিশ মামলার তদন্ত করে মৃত ব্যক্তি এবং শিশুর নামেও চার্জশিট দেয়৷ আর তদন্ত চলাকালে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছিল৷ ২০১৭ সালের মে মাসে মামলাটির বিচার পর্যায়ে এই ঘটনা ধরা পড়ে।
কোথাও নাশকতা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটলে সেটি যেমন লুকিয়ে রাখা যায় না, তেমনি ঘটনা না ঘটলে তা জোর করে প্রমাণও করা যায় না। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে শত শত মামলা হয়েছিল, যা পরে প্রমাণিত হয়নি। নির্বাচনের পর সেসব মামলাও হিমঘরে চলে গেছে।
২০২৪ সালের নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে নতুন করে গায়েবি মামলা দেওয়ার গুরুতর অভিযোগ এসেছে। কারওয়ান বাজার এলাকায় ককটেল ফাটানো ও একটি ভ্যানগাড়িসহ বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগের দায়ে মামলা হয় গত ১০ মে তেজগাঁও থানায়। এতে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ৩৭ জনের নাম এবং অজ্ঞাতনামা ৭৫ থেকে ৮০ জনসহ শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
মামলার এজাহার অনুযায়ী, ৯ মে (সোমবার) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে ৭টা ৫০ মিনিটে ওই ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজন, মামলার সাক্ষীরাও সেদিন ককটেলের বিস্ফোরণ ও অগ্নিসংযোগের এমন ঘটনা দেখেননি বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। কারওয়ান বাজারের কথিত ঘটনার একজন সাক্ষী বলেন, ‘আমি সড়কের কোথাও ককটেল বিস্ফোরিত হতে কিংবা আগুন দিতে দেখিনি।’ বনানী, ওয়ারী, শাহজাহানপুর, উত্তরা ও যাত্রাবাড়ীর ঘটনার সাক্ষীরাও একই কথা বলেছেন।
চলতি বছরের মে মাস থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত ককটেলের বিস্ফোরণ, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে রাজধানীতে ছয়টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি হিসেবে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ১৫০ নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে আসামি করা হয় সাত শর বেশি মানুষকে। সবার বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন ও দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।
কেবল ঢাকা নয়, রাজশাহীসহ দেশের অন্যান্য স্থানেও গায়েবি মামলার খবর পাওয়া গেছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেন, ২২ আগস্ট থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৯৬টি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪৪৫ জনকে। এসব মামলায় আসামি হিসেবে ৪ হাজার ৪১২ জনের নাম উল্লেখ করা হয়।
এর আগে ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে কেবল সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা মহানগরে ককটেলের বিস্ফোরণ ও নাশকতার অভিযোগে বিরোধী নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৫৭৮টি মামলা হয়েছিল; যার কোনোটি সরকার প্রমাণ করতে পারেনি। তাহলে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ভয় পাইয়ে দিতে, হয়রান করতেই এসব মামলা দায়ের করা হলে সেটি খুবই উদ্বেগজনক।
এসব মামলা আমাদের সেই মিথ্যাবাদী রাখালের গল্পের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। বাঘ আসছে বাঘ আসছে বলে রাখাল দিনের পর দিন গ্রামবাসীকে ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছিলেন। পরে সত্যি সত্যি যখন বাঘ এল, তখন আর গ্রামবাসী রাখালের কথা বিশ্বাস করেনি, তাকে উদ্ধারে কেউ এগিয়েও আসেনি।
সন্ত্রাস, অন্তর্ঘাত, নাশকতার ঘটনা ঘটলে সরকার অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। এ নিয়ে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। বরং সে ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থাও বাড়বে।
কিন্তু তারা যদি বিরোধী দলকে শায়েস্তা করতে এভাবে গায়েবি মামলা দিতে থাকে, তার পরিণাম কখনো ভালো হতে পারে না। ভবিষ্যতে সত্যি সত্যি যদি নাশকতার ঘটনা ঘটে, তখন মানুষ থানা-পুলিশের কথা বিশ্বাস করবে না।
মামলা দিয়ে কাবু করতে চায় আ’লীগ
প্রায় ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে ভোটের দাবিতে আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছে দলটি। তবে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির প্রায় ৩৬ লাখ নেতাকর্মীর মাথায় ঝুলছে লক্ষাধিক মামলার খড়গ।
সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির যত এগিয়ে যাচ্ছে তত বিএনপির বিরুদ্ধে পুরনো মামলাগুলো সচল হচ্ছে। পাশাপাশি দায়ের করা হচ্ছে নতুন মামলা। গত একমাসে বিএনপির বিভিন্ন নেতাদের বিরুদ্ধে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৭৫ টি মামলা রেকর্ড করা হয়েছে।
এই মামলাগুলো শুধু রেকর্ড নয়, মামলাগুলোর তদন্ত এগিয়ে নেওয়া এবং মামলাগুলোতে চিহ্নিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
পাশাপাশি পুরনো যে মামলাগুলো রয়েছে সেই মামলাগুলো সচল করা হচ্ছে এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকার পরও যাদেরকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরিভাবে বলে দিয়েছেন যে, যারা অগ্নিসংযোগ লুটপাট করেছে, বাসে আগুন দিয়েছে, ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে, তাদেরকে ছাড়া হবে না এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো সচল করতে হবে এবং তাদেরকে অনতিবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে। এই তদন্ত গুলো শেষ করতে হবে।
‘খুনি, অগ্নিসন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আইন তার আপন গতিতে চলবে’ বলে হুঁশিয়ার উচ্চারণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব সন্ত্রাসী এতদিন লুকিয়ে থাকলেও বিএনপির সঙ্গে মাঠে নামবে, সতর্ক করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, জীবন্ত মানুষ হত্যা করেছে, হাত কেটেছে, চোখ তুলেছে, মানুষকে নির্যাতন করেছে; তাদের ছাড় নেই। এসব আসামিকে ধরতে হবে। আইন তার আপন গতিতে চলবে।’
প্রধানমন্ত্রীর কঠোর অবস্থানের পর পরই নড়েচড়ে বসেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সূত্র মতে, ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত সময়ে বিএনপির বিভিন্ন নেতাদের বিরুদ্ধে চার হাজারের কাছাকাছি মামলা রয়েছে (৩৯১৮ টি)। এছাড়াও বিভিন্ন রকম অপরাধের কারণে বিএনপির বিভিন্ন নেতারা আরও ১৯৫ টি মামলার সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত।
এই চার হাজার মামলার মধ্যে খুব কম মামলাই নিষ্পত্তি হয়েছে। হিসাবপত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ২০১৩ সালে যে প্রায় দেড় হাজার মামলার মধ্যে মাত্র ২৭ টি মামলার চার্জশিট হয়েছে, বাকি মামলাগুলোর আর চার্জশিট হয়নি। এই সমস্ত মামলায় ১০ লাখের বেশি মানুষের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল।
তবে শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে খুব কম সংখ্যক মানুষ। এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেই পুরনো মামলার ফাইল গুলোকে আবার সামনে নিয়ে আসছে এবং যাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে তাদেরকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।
বিএনপির বক্তব্য
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সরকার আবারও পুরনো কায়দায় হয়রানিমূলক ও গায়েবি মামলা দিচ্ছে। গত সোমবার (২১ নভেম্বর) বিকেলে শুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
আওয়ামী লীগের কোনো ম্যান্ডেট নেই জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, সরকার বিএনপির সমাবেশ দেখে ভীত হয়ে এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে গোটা দেশে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করছে। জনগণ তাদের বিরুদ্ধে জেগে উঠতে শুরু করেছে। এখন বিনা কারণে রাতের বেলা অভিযান চালিয়ে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। বিএনপির সমাবেশে যেন লোকসমাগম কম হয়, এ জন্য সরকার মিথ্যা মামলা দিতে শুরু করেছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, গত ২২ আগস্ট থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে ৯৬টি মামলা হয়েছে। মামলায় ৪৪৫ জনকে গ্রেপ্তার ও ৪ হাজার ৪১২ জনকে এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া ১০ হাজার ৬৬৪ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশকে বাধাগ্রস্ত করতে ইতোমধ্যে ঢাকা মহানগরী উত্তরে পাঁচ মামলায় ৬২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দক্ষিণের ২৪৫ জনের নামে ১০টি মামলা হয়েছে।
তিনি বলেন, যে সব জায়গায় বিভাগীয় সমাবেশ হয়েছে সেখানে মামলা করেছে সরকার। এখন বাকি সমাবেশগুলো যাতে সফল না হয় সে জন্য নতুন নতুন মামলা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের নেতাকর্মীদের হয়রানি করা হচ্ছে। মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সাতটি বিভাগীয় সমাবেশ সফল হয়েছে। সামনের সব আন্দোলন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সফল করে এই সরকারকে বিদায় করা হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১২১৫
আপনার মতামত জানানঃ