১৭৮৫ সালের ২১ নভেম্বর লেবাননে জন্ম হয় উইলিয়াম বিউমন্টের। ১৮১২ সালে ক্যানাডার সাথে যুদ্ধের সময় তিনি একজন সার্জনের সহকারী হিসেবে কাজ করেন। তিন বছর পর লড়াই শেষ হলে বিউমন্ট নিউ ইয়র্কে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেন। পাঁচ বছর পর তার এক আত্মীয়কে পসার বুঝিয়ে দিয়ে আবারও সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি, তাকে পাঠানো হয় ফোর্ট ম্যাকিন’ওতে [লেক মিশিগান আর লেক হুরনের মাঝে ছোট্ট এক দ্বীপ। স্থানীয় চিপাওয়া আর অটোয়া গোত্র এর নাম দিয়েছে মিশিলম্যাকিনাক। বর্তমানে এর নাম ম্যাকিন’ও]।
বিউমন্ট ছিলেন কেবলই একজন চিকিৎসক। গবেষণায় কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না তার। অথচ তার কাছেই ধরা দেয় বিপাকক্রিয়া গবেষণার সুবর্ণ সুযোগ। আর সেই সুযোগ আসে ক্যানাডিয়ান ট্র্যাপার সেইন্ট মার্টিনের সৌজন্যে। ১৮২২ সালের জুন মাসে ২০ বছরের অ্যালেক্সিস সেইন্ট মার্টিন আমেরিকান ফার কোম্পানির ম্যাকিন’ওর সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছিলেন। সেখানে কোম্পানির দোকানের সামনে জিনিসপত্র কেনার লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তার পালা এলে দোকান ঢোকেন সেইন্ট মার্টিন, হঠাৎ করেই দুর্ঘটনাবশত সেখানে রাখা শটগান থেকে গুলি ছুটে যায়।
সেইন্ট মার্টিন ছিলেন দু’ফুটেরও কম দূরত্বে। মারাত্মকভাবে আহত হন তিনি। তার পেটে ফুটো তৈরি হয়, সেখান দিয়ে ফুসফুস আর পাকস্থলির অংশবিশেষ বেরিয়ে আসে। খবর পেয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যে ঘটনাস্থলে হাজির হন বিউমন্ট। যতটুকু সম্ভব চিকিৎসা দিলেও রোগীর সেরে ওঠার ব্যাপারে একেবারেই আস্থাশীল ছিলেন না তিনি।
ঘন্টাখানেকের ভেতর প্রচণ্ড জ্বরে কাবু হয়ে পড়েন রোগী, ক্ষতস্থানে সংক্রমণের সমস্ত লক্ষণ পরিস্ফুট হতে আরম্ভ করে। বিউমন্ট তাকে খাওয়াতে চেষ্টা করলে পেটের ফুটো দিয়ে খাবার আর পানি বেরিয়ে যায়। তবে সেইন্ট মার্টিন চিকিৎসককে আশ্চর্য করেন তার সহ্যশক্তি দিয়ে। আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি, পেটের ফুটোর চারপাশের পেশীর চাপে ফুটোর উপর ঢাকনার মতো তৈরি হয়। এই ঢাকনা চাপ দিয়ে ধরে রেখে খেলে সমস্যা হতো না।
দুর্ঘটনার পর সেইন্ট মার্টিনকে আমেরিকান ফার কোম্পানি চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়। তিনি ম্যাকিন’ও দ্বীপের স্থানীয় ছিলেন না, ফলে স্থানীয়দের থেকেও কোনো সহায়তা পাবার উপায় ছিলো না। তারা পরামর্শ দিলো তিনি যাতে ঘরে ফিরে যান, প্রায় ২,০০০ মাইল দূরে কুইবেকে।
বিউমন্ট বুঝতে পারলেন শরীরের এই অবস্থায় যাত্রার ধকল সামলাতে পারবে না সেইন্ট মার্টিন। তিনি তাকে গৃহভৃত্যের চাকরি দেন। তার মনে সুপ্ত ইচ্ছে সেইন্ট মার্টিন মোটামুটি শক্তি ফিরে পেলে তাকে নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করবেন। তার লক্ষ্য সেইন্ট মার্টিনের পেটের ফুটো দিয়ে তার পাকস্থলীর বিপাকক্রিয়া দেখা।
১৮২৫ সালের পয়লা আগস্ট নাগাদ সেইন্ট মার্টিন পরীক্ষার উপযুক্ত হয়ে উঠলেন। নানারকম খাবার সুতোয় বেঁধে পেটের ফুটো দিয়ে পাকস্থলীতে ঢুকিয়ে দেন, দেখতে লাগলেন কীভাবে বিভিন্ন খাবার শরীর প্রক্রিয়াজাত করছে। নির্দিষ্ট সময় পর পর সুতো টেনে খাবার বের করে বিপাকের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেন তিনি। এছাড়া পাকস্থলী থেকে রস নিয়ে গবেষণা করেন তিনি।
প্রায় নয় বছর ধরে পরীক্ষা করেন তিনি। তবে এখানে প্রশ্ন কী পেয়েছিলেন বিউমন্ট? তিনি পাকস্থলীতে বিপাকক্রিয়া নিয়ে এমন অনেক তথ্য পান যা কিনা চিকিৎসাবিজ্ঞানকে এগিয়ে দেয় অনেক দূর। ১৮৩৩ সালে নিজের অর্থে একটি বই বের করে (Experiments and Observations on the Gastric Juice and the Physiology of Digestion) সেইন্ট মার্টিনের থেকে প্রাপ্ত তথ্য প্রকাশ করেন তিনি। গবেষণার ফলাফল হিসেবে প্রায় পঞ্চাশটি অনুসিদ্ধান্ত বর্ণনা করেন সেখানে।
বিউমন্ট পাকস্থলী থেকে যে রস আহরণ করেছিলেন তার বিশ্লেষণ করেন ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবলেই ডাংলিংসন। তিনি খুঁজে পান হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের অস্তিত্ব। বিউমন্ট অবশ্য ধারণা করেন অ্যাসিডের বাইরেও আরো কোনো উপাদান খাবার হজমে সাহায্য করে। ১৮৩৬ সালে পাচক রসে পেপসিন বলে একপ্রকার এনজাইম আবিষ্কৃত হলে তার কথার সত্যতা প্রতিপাদিত হয়।
বই প্রকাশিত হবার পর বিউমন্ট অবশ্য সেইন্ট মার্টিনকে আরো কিছু পরীক্ষার জন্য আসতে বলেছিলেন, তবে তিনি সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন।
চিকিৎসা গবেষণার নৈতিকতা নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের মধ্যে বিউমন্টের গবেষণা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক আছে। তিনি কি কেবল পরীক্ষার গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহারের জন্য সেইন্ট মার্টিনের যত্নআত্তি করেছিলেন, নাকি চিকিৎসক হিসেবে নিজের দায়বদ্ধতা থেকে?
অনেকে বলে থাকেন সেইন্ট মার্টিনকে প্রথমে আশ্রয় দিয়েছিলেন মেরি লাফ্লুর নামে এক নারী, পরে বিউমন্ট যখন দেখতে পেলেন তার পেটের ফুটো দিয়ে পাকস্থলী দেখা যায় তখন গবেষণা কাজে ব্যবহারের জন্য তাকে নিয়ে আসেন।
আরেকটি বিষয় হলো বিউমন্ট প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন গবেষণা শেষ হলে অপারেশন করে স্থায়ীভাবে তার ফুটো বন্ধ করে দেবেন। তবে তিনি সেরকম কিছু করেননি। রোগীর থেকে যথাযথ অনুমতি নিয়ে তিনি কাজ করেছিলেন কিনা সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮০৫
আপনার মতামত জানানঃ