পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। সরকারের ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বিবেচনায় নিয়ে গড়ে ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ দাম বাড়ানো হলো এবার। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৫ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে এখন ৬ টাকা ২০ পয়সা। এটি ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে। এতে শিগগিরই গ্রাহক পর্যায়ে বাড়তে পারে বিদ্যুতের দাম।
আজ সোমবার দুপুরে অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে বিইআরসি। সংস্থাটি অবশ্য এর আগে গত মাসে দাম বাড়ানোর আবেদন খারিজ করে দিয়েছিল। ওই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য ১৩ নভেম্বর আপিল করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এটি আমলে নিয়েই এবার দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানান বিইআরসির চেয়ারম্যান আবদুল জলিল। এরপর গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানোর আবেদন করবে বিতরণ কোম্পানি। আবেদন যাচাই–বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেবে কমিশন।
গত এক যুগে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে নয়বার। এ সময় পাইকারি পর্যায়ে ১১৮ শতাংশ ও গ্রাহক পর্যায়ে ৯০ শতাংশ বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। সবশেষ দাম বাড়ানো হয় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে, যা ওই বছরের মার্চ থেকে কার্যকর হয়। ওই সময় পাইকারি পর্যায়ে ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ বাড়ানো হয় দাম। একই সময়ে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ।
বিইআরসি সূত্র বলছে, বিদ্যুৎ খাতে গত অর্থবছরে ভর্তুকি চাহিদা ২৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। চলতি অর্থবছরে ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রেখেছে সরকার। এর বাইরে পিডিবির যে রাজস্ব–ঘাটতি থাকবে, তা পূরণ করতে দাম এখন বাড়ানো হবে।
তবে এভাবে দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করেছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম বলেছেন, পিডিবি যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে না পারায় দাম বাড়ায়নি বিইআরসি। এখন পিডিবি যে ব্যাখ্যা দিয়েছে; তা নিয়ে ক্যাব ও অন্য পক্ষের বক্তব্য নিতে হবে। তাই পুনরায় শুনানি ছাড়া দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ–সংকটে পড়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নিচ্ছে সরকার। এর বাইরে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) কাছ থেকেও আর্থিক সহায়তা নিচ্ছে সরকার। এসব সংস্থা ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ দিয়েছে। তাই এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো।
গত ১২ জানুয়ারি গড়ে ৬৬ শতাংশ দাম বাড়ানোর আবেদন করে পিডিবি। তথ্যের অসম্পূর্ণতা থাকায় তা আমলে না নিয়ে পুনরায় আবেদন করার নির্দেশনা দেয় বিইআরসি। এরপর পুনরায় আবেদন জমা দিলে তা নিয়ে ১৮ মে শুনানির আয়োজন করা হয়। এতে ভর্তুকি ছাড়া ৫৮ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় বিইআরসি গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। তবে ক্যাব ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করেন শুনানিতে। বিদ্যুৎ খাতের অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি, অনিয়ম নিয়েও নানা প্রশ্ন তোলেন তাঁরা।
শুনানি শেষে এরপর ১৩ অক্টোবর দাম না বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বিইআরসি। এ সময় বলা হয়, ভোক্তার ওপর দাম বাড়ানোর প্রভাব কী হবে; এর কোনো মূল্যায়ন করেনি তারা। বারবার চাইলেও যথাযথ তথ্য জমা দেয়নি তারা। তথ্যের অস্বচ্ছতার কারণে পিডিবির তথ্য-উপাত্ত যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করা যায়নি। কোনো পক্ষের আপত্তি থাকলে ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে আপিল করার কথাও বলা হয় আদেশে, যা মেনে আবেদন করেছে পিডিবি।
জ্বালানিসংকটে পড়ে জুলাইয়েই সারা দেশে লোডশেডিং শুরু করে সরকার। জুনে গ্যাসের দাম ও আগস্টে বাড়ানো হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম। এতেও জ্বালানি সরবরাহ পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। বরং বাজারে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় দাম বাড়ানো নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়। এরপর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার। এখন সরকারের উচ্চপর্যায়ের সংকেত নিয়েই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো বলে জানা গেছে।
এম শামসুল আলম বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর সরকার ব্যাপক চাপের মুখে পড়ে। দেশে ওই সময় চরম লোডশেডিং চলছিল। তাই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। এখন শীতের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা কমায় লোডশেডিং বন্ধ হওয়ার সুযোগ নিয়ে দাম বাড়ানো হচ্ছে। এটা ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণার শামিল।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিইআরসির সদস্য মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী, আ ব ম ফারুক, মোহাম্মদ বজলুর রহমান ও মো. কামরুজ্জামান।
এসডব্লিউএসএস/১৫০৫
আপনার মতামত জানানঃ