ল্যাবরেট ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডিয়া লিমিটেডের উৎপাদিত ওষুধ ইস্কাফ সিরাপ। মানবদেহের জন্য অতিমাত্রায় ক্ষতিকর উপাদন থাকায় ভারতে নিষিদ্ধ হওয়ার পর এ ওষুধ চোরাকারবারিদের মাধ্যমে চলে আসছে সীমান্তের এপারে। ব্যবহার হচ্ছে ভয়ংকর মাদক হিসেবে।
এ ধরনের ওষুধ দেহে দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগ তৈরি করে। শুধু ইস্কাফ সিরাপই নয়, এমন অন্তত এক ডজন নিষিদ্ধ ওষুধেরও বড় গন্তব্য এখন বাংলাদেশ। আর এ নিষিদ্ধ ওষুধ ঘিরে সীমান্ত এলাকাগুলোয় চলছে শতকোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য।
ইস্কাফ সিরাপটির মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহার হয়েছে কোডিন ফসফেট লিঙ্কটাস এবং ক্লোরফেনিরামিন। কোডিন ফসফেট লিঙ্কটাস মূলত হালকা থেকে মাঝারি ও গুরুতর ব্যথা উপশমের জন্য ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। উপাদানটিতে মরফিন এবং হাইড্রোকডোনের উপস্থিতি থাকায় দীর্ঘদিন সেবনে মাদকপ্রবণতা তৈরিরও শঙ্কা রয়েছে।
কোডিনযুক্ত ওষুধ সেবনের ফলে শ্বাসনালিতে প্রদাহ, হাড়ের পেশিতে ব্যথা, ফুসফুসে সংক্রমণসহ মানবদেহে বেশকিছু সমস্যা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা দেয়। এ ওষুধের আরেকটি উপাদান ক্লোরফেনিরামিন একটি অ্যান্টিহিস্টামিন, যা শরীরের হিস্টামিনের ক্রিয়া বন্ধ করে কাজ করে।
এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে মাথা ঘোরা, বিভ্রান্তি, কোষ্ঠকাঠিন্য, বমি বমি ভাব, অস্থিরতা, শ্বাসকষ্ট এমনকি হ্যালুসিনেশনের মতো বিভ্রমও তৈরি হয়।
কোডিন ফসফেট লিঙ্কটাস এবং ক্লোরফেনিরামিন দিয়ে তৈরি করা ওষুধ মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বলে মত বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, এ ধরনের ওষুধ সেবনে এক ধরনের নির্ভরতা তৈরি হয়ে যায়। ফলে অনেকেই এ ওষুধ দীর্ঘমেয়াদি সেবন করে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে এটি মাদক হিসেবেও ব্যবহার হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রির অধ্যাপক ড. আব্দুল মজিদ বলেন, ইস্কাফ সিরাপের মূল উপাদান কোডিন ফসফেট লিঙ্কটাস ও ক্লোরফেনিরামিন। এর মধ্যে কোডিনে মাদকের উপাদান থাকায় এটি বাংলাদেশে ব্যবহার নিষিদ্ধ। এ ধরনের ওষুধগুলো মূলত ব্যথানাশক হিসেবে ব্যবহার হয়। তবে এ ধরনের ওষুধ দীর্ঘদিন সেবনে মানবদেহে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) তথ্য অনুযায়ী, সীমান্ত এলাকা দিয়ে সবচেয়ে বেশি ইস্কাফ, এমকেডিল, কফিডিল, কোরেক্স, ফেনসিডিল, এনেগ্রা ও সেনেগ্রার মতো উত্তেজক ওষুধ পাচারের চেষ্টা করে থাকেন চোরাকারবারিরা। এছাড়া বেশকিছু ইনজেকশন অবৈধ পথে সীমান্ত অতিক্রম করে দেশের বাজারে সরবরাহের চেষ্টা করে থাকে চোরাকারবারিরা।
শুধু চলতি বছরের গত ১০ মাসে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা থেকে পাচারের সময় ৬৯ হাজার বোতল ইস্কাফ সিরাপ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ধরনের নিষিদ্ধ ওষুধ সবচেয়ে বেশি রংপুর, দিনাজপুর, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা ও ফুলবাড়ী সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে পাচারের চেষ্টা হয়।
প্রায় ১৫ কিলোমিটার ভারত সীমান্তঘেঁষা এলাকা নিয়ে দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলা। এ ১৫ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকায় নজরদারির জন্য ছয়টি বিজিবি ক্যাম্প রয়েছে। এখানে কয়েকটি গ্রাম রয়েছে, যা বাংলাদেশ নাকি ভারত অংশে তা অনুমান করার উপায় নেই।
ভারত-বাংলাদেশ সীমানা নির্ধারণে কোথাও রয়েছে শুধু একটি ছোট নালা, পুকুর বা সীমান্ত পিলার। ভারতীয় অংশের গ্রামগুলোয় ২০০ থেকে ৪০০ গজ অভ্যন্তরে রয়েছে কাঁটাতারের বেড়া। ফলে ভারত সীমান্তবর্তী গ্রামের নাগরিকরা বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশ সীমান্তের নাগরিকরা অবাধে ভারতে প্রবেশ করে থাকে।
ভারতের ত্রিমোহিনী থেকে বালুরঘাট এলাকায় বেশকিছু ছোট কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় এমকেডিল নামে নতুন এ মাদক তৈরি হচ্ছে। ভারতের ভেতর থেকে জারকিনে করে তরল হিসেবে ভারতের হিলি বাজারে আনা হয় এই এমকেডিল। পরে সেখান থেকে বেশ কয়েকটি স্থানে বোতলজাত করে ভারতের প্রায় ৫০ জন ডিলারের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাচার করা হয়।
এদের মধ্যে ত্রিমোহিনী বাজারের দত্ত বাবু, তার ছেলে নেপাল বাবু, গোপাল ও কালিকাপুর গ্রামের মোজাফফর রহমান অন্যতম ডিলার। দেশের বাজারে এসব ওষুধ ১ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে ৩ হাজার টাকায়ও বিক্রি হয় এসব নিষিদ্ধ ওষুধ।
ভারতে নিষিদ্ধ কোডিন ম্যালাইড এবং ম্যানকফ ডিএক্স সিরাপও এখন বাংলাদেশে পাচার হচ্ছে। এছাড়া প্যাথেডিন, বুপ্রেনরফিন (টিডি জেসিক ইনজেকশন), কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মেন্টেড ওয়াশ (জাওয়া), বুপ্রেনরফিন, আইচ পিল, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পারম্যাংগানেট ও মিথাইল-ইথাইল কিটোন পাচার হয়ে বাংলাদেশে আসছে।
এসডব্লিউএসএস/১৬৩০
আপনার মতামত জানানঃ