১০৯৯ সালে প্রথম ক্রুসেডের পর ইউরোপীয়রা প্রথমবারের মতো জেরুজালেমে তীর্থযাত্রা শুরু করে। এটি শুধু লেভান্টের মুসলিমদের হাত থেকে পবিত্র ভূমি পুনরুদ্ধার করার জন্যই নয়, বরং খ্রিস্টানরা তাদের পূর্বের বিশ্বাসের জন্মস্থান পরিদর্শন করার অভিপ্রায়ে একটি পথ উন্মুক্ত করার জন্যেও লড়াই করেছিলেন।
তবে ওই পথটি চালুর পরেও পুরোপুরি নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি সেখানে। তখন ইতালি থেকে জেরুজালেম পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রায় দুই মাস সময় লাগতো। অথচ উপনিবেশিক সময়ে ব্রিটেন থেকে নিউ ইয়র্ক পৌঁছাতে এর চেয়ে কম সময় ব্যয় হতো।
এই তীর্থযাত্রায় যাত্রীরা যদি ২ মাসের বেশি সময় ধরে পথ চলেন তাহলে তারা স্বাভাবিকভাবে যুদ্ধ, মহামারীর কবলে পড়তেন। আবার ওই সময় ডাকাতি ছিল অতি সাধারণ ঘটনা। তীর্থযাত্রীদের পথে খাবার ও বাসস্থানের জন্য যথেষ্ট অর্থ বহন করতে হতো। এছাড়াও তারা সাধারণত নিরস্ত্র এবং অপ্রশিক্ষিত ছিল। এতে করে ডাকাতরা লুটপাটের জন্য তাদেরকেই বেছে নিত।
তবে এই ক্ষেত্রে একেবারেই আলাদা ছিল ব্রিটিশ নাগরিকরা। ব্রিটিশ ভ্রমণকারীদের লন্ডনে টেম্পল চার্চ নামে পরিচিত একটি সংস্থা ছিল। সেখানে তীর্থযাত্রীরা তাদের সঞ্চয়ের একটি অংশ জমা করতে পারতেন। বিনিময়ে তাদের একটি ক্রেডিট চিঠি দেয়া হয়েছিল। ওই চিঠির মাধ্যমে তারা জেরুজালেমে পৌঁছানোর পর সঞ্চয়গুলো উত্তোলন করতে পারতেন।
টেম্পল চার্চের এমন পরিষেবাগুলো পবিত্র ভূমিতে তীর্থযাত্রাকে অনেক বেশি নিরাপদ করে তুলেছিল। এতে করে তীর্থযাত্রীরা যাত্রার শুরুতে তাদের সাথে এত টাকা বহন করতে হতো না। সেই সাথে কমে যায় ডাকাতদের আক্রমণ। এছাড়াও, যদি তারা কোনো কারণে ছিনতাই হয় তাহলে গন্তব্যে পৌঁছানোর পরেও টাকা ফেরত পেতো।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে ওই ব্যাংকিং পদ্ধতিকে বলা হয়, ক্রুসেডের ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন। ইতিহাসবিদরা প্রায়শই সংস্থাটিকে বিশ্বের প্রথম ব্যাংক হিসেবে উল্লেখ করেন। যদিও ওই ক্রেডিট চিঠির ধারণাটি একেবারেই মৌলিক ছিল না। সপ্তম শতকে চীনা বণিকরা একটি বিশেষ নোটের বিনিময়ে এজেন্সিতে তাদের মুদ্রার আংটি জমা দিতে পারতেন। মূল পার্থক্য ছিল যে, এই সংস্থাগুলো শাং রাজবংশ দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। যখন টেম্পল চার্চ একটি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন উদ্যোগ ছিল।
নাইট টেম্পলার
নাইট টেম্পলাররা ছিলেন ক্রুসেডের সময় পবিত্র ভূমিতে খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীদের রক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ যোদ্ধা। ১১১৮ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি নাইট হিউগুস ডি পেয়েন্সে এক সামরিক আদেশের মাধ্যমে টেম্পল অব সলোমন গার্ড বা নাইট টেম্পল প্রতিষ্ঠা করেন। ওই সময় জেরুজালেমের টেম্পল অব মাউন্ট ছিল এর সদরদপ্তর। প্রতিষ্ঠাকালে সদস্যরা আনুগত্য ও দরিদ্র জীবনযাপন, জুয়া-মদ ও শপথ করা থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। নাইট টেম্পলাররা সামরিক শক্তি ও নৈতিক জীবনযাপনের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। একপর্যায়ে একটি ব্যাংক স্থাপনের মধ্যদিয়ে ইউরোপের সর্বাধিক ধনী ও অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয় এরা।
ওই ব্যাংকের মাধ্যমে তীর্থযাত্রীরা নিজ দেশে অর্থ জমা করতে পারতেন এবং পবিত্র ভূমিতে ভ্রমণের অনুমতি নিতেন। ১১৩৯ খ্রিস্টাব্দে জবাবদিহিতার একেবারে বাইরে চলে যায় এই নাইট টেম্পলাররা। দ্বিতীয় পোপ ইনোসেন্ট সংগঠনের সদস্য ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে কর প্রদান থেকে অব্যাহতি দিয়ে আদেশ জারি করে। শুধুমাত্র পোপের নিকট তাদের জবাবদিহিতা রাখা হয়। অতিরিক্ত ক্ষমতা পেয়ে নাইট টেম্পলাররা সাইপ্রাস দ্বীপের মালিক হন।
সেখানে তারা একটি জাহাজ ভিড়িয়ে রাখত; যাতে থাকত অনেক ধনদৌলত ও অর্থ। বিভিন্ন দেশের রাজাদের এসব অর্থ ধার দিত এই সংগঠন। ইউরোপের আর্থিক ব্যবস্থার বিবর্তনে টেম্পল চার্চ যে ভূমিকা পালন করেছিল তা এখনও লোক মুখে সমাদৃত। এক সময় দেখা যায়, লন্ডনের প্রায় প্রতিটি পরিবারই এই লেনদেনের অংশীদার হয়ে উঠে। ১৩ শতকের পরে নাইট টেম্পলাররা তাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা সাধারণ মানুষদের জন্যেও উন্মুক্ত করে।
ক্রুসেডে অর্থায়ন
বলা হয়ে থাকে ক্রুসেড ছাড়া ওই নাইট টেম্পলাররা প্রতিষ্ঠিত হতে পারতো না। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রোনাল্ড গ্রসম্যানের লেখা একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ ‘ক্রুসেডের অর্থায়ন‘ শিরোনামে এই সীমাবদ্ধতাগুলো তুলে ধরা হয়। এই পন্থা প্রথম নজরে আসে ইংল্যান্ডের নরম্যান বিজয়ের সময়, যা খ্রিস্টান সৈন্যদের লেভান্টে যাত্রা করার কয়েক বছর আগে ঘটেছিল। নরম্যান বিজয় ছিল একটি ক্রুসেড। ভাসাল লর্ডরা আক্রমণের জন্য অভূতপূর্ব পরিমাণ সময় এবং লোকবল সরবরাহ করতে অনিচ্ছুক ছিল। তারা যুক্তি দিয়েছিলেন যে, শুধু তাদের পুরনো সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্কের ভিত্তিতে অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য করা যাবে না।
এতে করে সৈন্য সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ হাতে নেয় তারা। উইলিয়াম দ্য কনকারর যে দ্বীপটি দখল করতে চেয়েছেন সেখান থেকে যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ ভাগ করে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এমন সময় পোপ দ্বিতীয় আরবান মর্মান্তিক এই ক্রুসেডে অংশগ্রহণের জন্য প্রাথমিক পুরস্কার ঘোষণা করেন। অন্যদিকে অষ্টম গ্রেগরি তার ক্রুসেডারদেরকে বিলাসিতা বর্জনের আহ্বান জানান। এছাড়াও যুদ্ধে নিহতদের দেহাবশেষ দেখাতে পারলে অর্থমূল্য দেয়ার প্রচলন ছিল। এমতাবস্থায় ঊর্ধ্বতন সেনারা নিহত সেনাদের দেহাবশেষ চুরি করতো শুধু পুরস্কারের আশায়। এতে করে তাদের অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে বাঁচতে পেরেছিলেন। সৈনিকরা যখন যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাতে শুরু করে তখন বণিকরা ক্রুসেডে অংশ নেয়।
ভেনিসের ব্যবসায়ীরা লেবাননসহ ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্য নেটওয়ার্ক নিজেদের দখলে নিয়েছিল। অতঃপর মিশরে চতুর্থ ক্রুসেডের সময় ভেনিসের ব্যবসায়ীরা তাদের অর্জিত সম্পদকে একটি বিশাল নৌবহরে বিনিয়োগ করেছিল যা আলেকজান্দ্রিয়াকে আরও ধনী শহরে পরিণত করে। যদিও নাইট টেম্পলারদের মতো অন্য সংস্থাগুলো ক্রুসেড থেকে খুব কমই লাভবান হয়েছিল। পবিত্র ভূমি প্রতিরক্ষার কারণে এরা সবক্ষেত্রে ছাড় পেয়েছিল। রাজা, রানি এবং পোপরা এদের অনেক অন্যায় কাজের ছাড় দিতো।
ক্রুসেডের সমাপ্তির পর নাইট টেম্পলাররা প্যারিসে ব্যাংকিং ব্যবসায়ে মনোনিবেশ করে। ১৩০৭ সালের ১৩ অক্টোবর ফ্রান্সের তৎকালীন রাজা চতুর্থ ফিলিপ, নাইট টেম্পলারদের নিকট অতিরিক্ত ঋণ আবেদন করেন। এতে করে দু’পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সেদিন রাজার নির্দেশে একদল নাইটকে গ্রেপ্তারের পর নির্যাতন করা হয়।
কথিত আছে নাইটরা যতক্ষণ না বঞ্চনার মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিয়েছিল ততক্ষণ চলেছিল ওই নির্যাতন। ১৩০৯ সালে প্যারিসে কয়েক ডজন নাইট টেম্পলারকে নামমাত্র অপরাধে পুড়িয়ে মারা হয়। নাইট টেম্পলাররা যখন দিন দিন সংকটময় পরিস্থিতিতে পড়ছিলেন তখন পঞ্চম পোপ ক্লিমেন্ট ১৩১২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্বের কর অব্যাহতির আদেশ বাতিল করে। সে সাথে তাদের সম্পদ পুনঃবন্টনের নির্দেশনা দেন।
এসডব্লিউএসএস/১৮২০
আপনার মতামত জানানঃ