১৮ মে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, খাদ্যের উচ্চমূল্যের কারণে দরিদ্র দেশগুলোয় খাদ্যসংকট তীব্র হয়েছে। ইউক্রেনের যুদ্ধাবস্থা দীর্ঘায়িত হলে বিশ্ব দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে পারে।
বাংলাদেশে খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি অনেক আগেই শুরু হয়েছে। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরুর পর থেকে এ মূল্যবৃদ্ধি মানুষের জীবন-জীবিকাকে আরও বেশি বিপর্যস্ত করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে গম ও ভোজ্যতেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া সব ধরনের জ্বালানি, যেমন তেল, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ও কয়লার দাম বেড়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়লে খাদ্যপণ্য ছাড়াও সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম আরও বাড়বে। এর পাশাপাশি শুরু হয়েছে টাকার অবমূল্যায়ন। আগের চেয়ে বেশি দামে খাদ্যপণ্য আমদানি করতে বাধ্য হচ্ছে বাংলাদেশ।
এরই মধ্যে কিছুদিন আগে প্রকাশিত একটি খবরে পিলে চমকে যায় বাংলাদেশের। আর তা হলো, সর্বোচ্চ চিনি উৎপাদনকারী দেশ ব্রাজিলের চিনিকলগুলো চিনি রপ্তানির চুক্তি বাতিল করে আখ থেকে ইথানল উৎপাদন করে রপ্তানি করতে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে সব ধরনের জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় আখ থেকে উৎপাদিত বায়োফুয়েলের (জৈব জ্বালানি) চাহিদা বেড়েছে। চিনির চেয়ে আখ থেকে ইথানল উৎপাদন অধিক লাভজনক হয়ে উঠেছে। আর স্বাভাবিক ভাবেই চিনির সংকট ঘনীভূত হলে এর দাম বাড়বে। হয়েছেও তাই।
বাজারে চাহিদা অনুযায়ী চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া গেলেও সরকার নির্ধারিত মূল্যের বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে। আমদানিকৃত চিনি পরিশোধন করে বিক্রয়কারী বেসরকারি চিনিকলগুলোর সামনে জমেছে চিনি নিতে আসা ট্রাকের দীর্ঘ সারি। সংকটের সুযোগ নিয়ে বিশেষ চাহিদা আদেশের (ডিও) মাধ্যমে মিলগুলোর বিরুদ্ধে বেশি দামে চিনি বিক্রির অভিযোগ উঠেছে।
চিনির এই সংকটের পেছনে বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির মূল্যবৃদ্ধির কথা বলা হলেও গুরুত্বপূর্ণ একটা কারণ হলো, বেসরকারি আমদানিকারকদের ওপর একক নির্ভরশীলতা। বর্তমানে দেশে চিনির চাহিদা ১৮ থেকে ২০ লাখ টন।
রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো একসময় বছরে দেড় থেকে দুই লাখ টন চিনি উৎপাদন করত, যা বাজার নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করত। কিন্তু গত দুই বছরে ১৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলের মধ্যে ৬টির উৎপাদন বন্ধ রাখায় দেশীয় উৎপাদন কমে ৩০ হাজার টনে নেমে এসেছে। এতে দেশের চিনি খাত প্রায় শতভাগ আমদানিভিত্তিক বেসরকারি কলগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ফলে চিনির বাজারের ওপর সরকারের কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানিনির্ভরতা কমানোর কথা বলা হচ্ছে। অথচ যে খাতের বিকাশ হলে আমদানিনির্ভরতা হ্রাস করে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা যেত, সেই রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকে নিদারুণ অবহেলার মধ্যে ফেলে রাখা হয়েছে। যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হলে রাষ্ট্রায়ত্ত কলগুলো চাহিদার উল্লেখযোগ্য অংশ সরবরাহ করতে পারত, সেই সঙ্গে হাজারো আখচাষি ও শ্রমিকের কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখতে পারত।
রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলোর সংকটের একটা বড় কারণ হলো উৎপাদন খরচ আমদানিকৃত চিনির বাজারদরের তুলনায় অনেক বেশি। আর কলগুলোর বাড়তি উৎপাদন খরচের কারণ হলো—এক. কলগুলো মাড়াই করার মতো পর্যাপ্ত আখ পায় না, এতে বছরের একটা বড় সময়জুড়ে সেগুলো বন্ধ থাকে, যদিও বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন খরচ সারা বছরই বহন করতে হয়। দুই. যে আখ পাওয়া যায়, তা থেকে চিনি আহরণের পরিমাণ তুলনামূলক অনেক কম—৬–৭ শতাংশ। ভারতে বা ব্রাজিলে এই হার ১২–১৪ শতাংশ।
ফলে ১০০ কেজি আখ থেকে ভারত বা ব্রাজিল যে পরিমাণ চিনি আহরণ করে, বাংলাদেশ করে তার প্রায় অর্ধেক। চিনি উৎপাদনের মোট খরচের প্রায় ৪০ শতাংশই হয় কাঁচামাল বাবদ। চিনি আহরণের এই অতি নিম্ন হারের কারণে বাংলাদেশে কলগুলোর কাঁচামাল বাবদ খরচ ভারতীয় কলগুলোর তুলনায় দ্বিগুণ, যা শেষ পর্যন্ত প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে বাড়তি খরচ হিসেবে যোগ হচ্ছে।
মাড়াইয়ের জন্য পর্যাপ্ত আখ যায় না কেন? কারণ, খরচের তুলনায় আখের দাম পাওয়া যায় না, চিনিকলে সময়মতো বিক্রি করা যায় না এবং সময়মতো অর্থও পাওয়া যায় না। ফলে কৃষকেরা আখের বদলে ধান বা সবজি চাষ করছেন, আর যাঁরা আখ চাষ করছেন, তাঁরা চিনিকলের বদলে গুড় উৎপাদকের কাছে বিক্রয় করছেন। আরেকটি কারণ হলো, চাষাবাদ ব্যবস্থার বিভিন্ন সংকটের কারণে একরপ্রতি আখের ফলন ১৮ থেকে ১৯ টন, যা অন্যান্য আখ উৎপাদনকারী দেশের তুলনায় খুবই কম। যেমন সারা ভারতের গড় উৎপাদন ২৮ টন।
চিনিকলগুলোয় চিনি আহরণের হার এত কম হওয়ার কারণ কী? সেটি নির্ভর করে আখে কী পরিমাণ চিনি রয়েছে এবং আখে থাকা চিনির কতটুকু কারখানায় যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আহরণ করা সম্ভব হচ্ছে, তার ওপর। চিনিকল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হচ্ছে, কৃষকদের কাছ থেকে কেনা আখের চিনি ধারণক্ষমতা ৮ থেকে ৯ শতাংশ; ২.৩৫ থেকে ২.৪০ শতাংশ কারখানা লস যুক্ত করেই।
অন্যদিকে ইক্ষু গবেষণা সংস্থার বক্তব্য হলো আখে চিনির পরিমাণ ১২ শতাংশের কম থাকে না। মূলত কারখানাগুলোতে চিনি লস বা অপচয় বেশি হওয়ার কারণেই আহরণের হার কম হয়। এই অপচয় অনুমোদিত মাত্রার মধ্যে দেখানোর জন্য পেছন থেকে হিসাব করে আখের চিনির হার কম করে দেখানো হয় বলেও অভিযোগ আছে। আসলে চিনি কম পাওয়ার পেছনে আখে চিনির হার, খেত থেকে আখ পরিবহনের সমস্যা এবং কারখানায় অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণ আহৃত হওয়া—এসব সমস্যাই কমবেশি দায়ী। আবার অঞ্চলভেদে মাটির বৈশিষ্ট্য, জমির উচ্চতা, আবহাওয়া ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে উপযুক্ত জাতের আখ চাষ না হওয়াও আখে চিনির হার কম হওয়ার বড় একটি কারণ।
অন্যদিকে আখে চিনি থাকলেও কম আহরণ হওয়ার কারণ হলো, আখ মাড়াই করে রস বের করার যন্ত্র (রোলার) ঠিকঠাক কাজ না করা, নষ্ট ও পুরোনো যন্ত্রপাতির ব্যবহার, রস প্রক্রিয়াজাত করার সময় রসের তাপমাত্রা ও অম্লত্ব নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে কম বা বেশি হওয়া ইত্যাদি। এ ছাড়া প্রতি টন আখ মাড়াইয়ে বিদ্যুতের ব্যবহার, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, আখ মাড়াইকালে সময়ের অপচয় ইত্যাদিও অনেক বেশি হওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
তা ছাড়া প্রতিবছর ঋণের সুদ বাবদ বিপুল অর্থ খরচ হওয়ার কারণেও চিনির উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। চিনির উৎপাদন খরচের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশই হলো ঋণের সুদ!
চিনিকলগুলোর লোকসানের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো আমদানিকৃত চিনির চেয়ে স্বাস্থ্যসম্মত ও ভালো দেশীয় চিনির বাড়তি চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলকভাবে সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণনব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন না আনার কারণে ডিলার থেকে পাইকারি বিক্রেতা এবং পাইকারি থেকে খুচরা বিক্রেতার কাছে চিনি পর্যাপ্ত পরিমাণে পৌঁছায় না। ফলে একদিকে আগ্রহী ক্রেতা বাজারে দেশি চিনি খুঁজে পায় না, অন্যদিকে চিনিকলগুলোর গুদামে অবিক্রীত চিনি নষ্ট হতে থাকে।
রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিশিল্প ও আখ চাষের এসব সমস্যা নতুন নয় এবং এগুলোর সমাধানের উপায়ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বহুদিন ধরেই জানা। এরপরও সমাধানের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ না নিয়ে চিনিকলগুলো বন্ধ করে ও অবহেলা করে চিনিশিল্পের এ সংকট আরও ঘনীভূত করা হচ্ছে।
সরকারের কোনো নীতির কারণে যদি কতগুলো বেসরকারি চিনিকল বন্ধ হয়ে যেত আর রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানার সামনে চিনির ট্রাকের দীর্ঘ লাইন হতো, তাহলে বন্ধ হয়ে যাওয়া বেসরকারি কারখানা নিয়ে চারদিকে যে ধরনের মাতম উঠত, রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোকে বন্ধ করে রাখার ক্ষেত্রে তেমনটি নেই কোথাও!
এসডব্লিউ/এসএস/১৩২০
আপনার মতামত জানানঃ