৫৫০ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল প্রাণীকূল। কিন্তু ঠিক কী কারণে পৃথিবী থেকে জীবনের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গিয়েছিল, তা নিয়ে এতদিন গবেষণার পর চাঞ্চল্যকর এক সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন গবেষকরা।
গবেষণায় উঠে এসেছে—পৃথিবী থেকে হঠাৎই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল অক্সিজেন। আর তার ফলেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল সব প্রাণীকুল।
ভূতাত্ত্বিক ও গবেষকরা জানিয়েছেন, পৃথিবী থেকে জীবনের এই গণবিলুপ্তির ঘটনা ৫৫০ মিলিয়ন বছর আগে বা এডিয়াকারান পিরিয়ডের আগে ঘটেছিল। এই ঘটনা ঘটেছিল অক্সিজেনের অপ্রতুলতার কারণে।
হঠাৎ করে অক্সিজেনের ঘাটতি যেমন অনেক প্রাণীজগৎকে নিঃশেষ করে দিয়েছিল, তেমনই অনেক প্রাণীর প্রভূত ক্ষতি হয়েছিল। অনেক প্রাণীর শারীরিক গঠন ও আচরণ ইঙ্গিত দেয়, বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কী হারে কমে গিয়েছিল তখন।
প্রসিডিংস অফ দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস-এ গবেষণাটি প্রকাশিত হয়। সেই গবেষণা রিপোর্টে এই গ্রহে জীবনের বিবর্তনমূলক গতিপথ বর্ণনা করা হয়েছে। এই বিলুপ্তির ঘটনায় ধ্বংস হওয়া প্রাণীদের দেহাবশেষ কেমন ছিল, তা বোঝার জন্য শিলায় জীবাশ্মের ছাপ নিয়ে গবেষণা চালান গবেষকরা।
প্রাণীকুলের বিলুপ্তির আগে যে সমস্ত জীবাশ্মগুলোর খোঁজ মিলেছিল, আর বিলুপ্তির পর যে সমস্ত জীবাশ্মের খোঁজ মেলে তার মধ্যে ব্যাপক তফাৎ ছিল। পৃথিবী থেকে এই বিলুপ্তের ঘটনা প্রাণীদের বিবর্তনের পথ প্রশস্ত করেছিল বলে ধারণা গবেষকদের।
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া টেক কলেজ অফ সায়েন্সের অন্তর্গত জিওসায়েন্স বিভাগের পোস্ট ডক্টরাল গবেষক স্কট ইভান্সের নেতৃত্বে গবেষকরা দেখিয়েছেন, বিশ্ব উষ্ণায়ন, ডি-অক্সিজেনেশন ইভেন্ট-সহ পরিবেশগত পরিবর্তনগুলি প্রাণীদের বিলুপ্তি, গভীর ব্যাঘাত সৃষ্টি ও পুনর্গঠনের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
এখন প্রশ্ন কেন পৃথিবী অক্সিজেন হারিয়েছিল? পৃথিবী পাঁচটি প্রধান গণবিলুপ্তির ঘটনার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। অর্ডোভিসিয়ান-সিলুরিয়ান বিলুপ্তি, যা ঘটেছিল ৪৪০ মিলিয়ন বছর আগে। ডেভোনিয়ান বিলুপ্তি, যা ঘটেছিল ৩৭০ মিলিয়ন বছর আগে। পার্মিয়ান-ট্রায়াসিক বিলুপ্তি ঘটেছিল ২৫০ মিলিয়ন বছর আগে। ট্রায়াসিক-জুরাসিক বিলুপ্তির ঘটনা ২০০ মিলিয়ন বছর আগে এবং ক্রিটেসিয়াস-প্যালিওজিন বিলুপ্তি ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে।
তবে গবেষকরা এখনও গ্রহের অক্সিজেনের মাত্রা হঠাৎ কমে যাওয়ার কারণটি সম্পূর্ণরূপে বুঝতে পারেননি। এটি আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে ঘটতে পারে, টেকটোনিক প্লেটের গতির কারণে ঘটতে পারে অথবা গ্রহাণুর প্রভাবে ঘটতে পারে। আবার এমন ধরনের অনেক কিছুর সংমিশ্রণে ঘটতে পারে।
তবে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটা যে অসম্ভব নয় তা বেশ আগেই জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, দ্রুত পৃথিবী থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে অক্সিজেন। এত দ্রুত হারে তা পৃথিবীর উধাও হয়ে যাচ্ছে মহাকাশে যে, রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন বিজ্ঞানীরা। ওজনে হালকা হয়ে পড়ছে পৃথিবী।
নাসার বিজ্ঞানীরা পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন, যেমনটা ভাবা হয়েছিল, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল প্রায় সেই ভাবেই উত্তরোত্তর পাতলা হয়ে এলেও, বাতাসের অক্সিজেন প্রত্যাশার চেয়ে অনেক দ্রুত হারে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে মহাকাশে।
দেখা গিয়েছে, সেই হারে কিন্তু পৃথিবী খুইয়ে ফেলছে না গাছপালাদের রান্নাবান্নার (সালোকসংশ্লেষ) জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইড। অক্সিজেনের মতো অত দ্রুত হারে পৃথিবীতে কমে যাচ্ছে না বাতাসের নাইট্রোজেন ও মিথেন। যা বেঁচে থাকার জন্য খুব কাজে লাগে অণুজীবদের।
বিজ্ঞানীদের অনুমান, বহু কোটি বছর আগে এমন দশাই হয়েছিল আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী ‘লাল গ্রহ’ মঙ্গলের।
মূলত পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল যে উত্তরোত্তর পাতলা হয়ে আসছে, তার ধারণাটা আমাদের প্রথম জন্মেছিল, গত শতাব্দীর গোড়ায়। ১৯০৪ সালে এমন সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন স্যর জেমস জিনস। তার ‘দ্য ডাইনামিক্যাল থিয়োরি অফ গ্যাসেস’ তাত্ত্বিক ভাবে জানিয়েছিল, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এক দিন আমাদের ছেড়ে মহাকাশে হারিয়ে যাবে। সেই দিন পৃথিবীর আর কোনও বায়ুমণ্ডল থাকবে না।
ফলে, বেঁচে থাকার অন্যতম প্রধান উপকরণটি আর পাবে না এই নীলাভ গ্রহের জীবজগৎ। তবে সেটা হতে সময় লাগবে আরও অন্তত ১০০ কোটি বছর।
কিন্তু নাসার বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, বায়ুমণ্ডলের উত্তরোত্তর পাতলা হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা অত ধীরে ঘটছে না। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ডগ রাউল্যান্ড জানান, ‘‘প্রতি দিন পৃথিবীর কয়েকশো টন বায়ুমণ্ডল আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে মহাকাশে। তার ফলে, খুব দ্রুত হারে তার ওজন হারিয়ে ফেলছে আমাদের এই গ্রহ। পৃথিবী দ্রুত হালকা হয়ে যাচ্ছে।’’
অক্সিজেন পরমাণুর যে পরিমাণ শক্তি রয়েছে, তার অন্ত ১০০ গুণ শক্তি প্রয়োজন বাতাসের অক্সিজেনকে পুরোপুরি পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে মহাকাশে চলে যেতে হলে। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রত্যাশার চেয়ে অনেক দ্রুত হারে পৃথিবী ছেড়ে চলে য়াচ্ছে অক্সিজেন। গত শতাব্দীর ছয় বা সাতের দশকেও অক্সিজেনের এই দ্রুত প্রস্থানের আঁচ মেলেনি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭২০
আপনার মতামত জানানঃ