সোশ্যাল মিডিয়ায় বা মেসেজিং অ্যাপের মাধ্যমে ফেক নিউজ, গুজব, পর্নোগ্রাফি, সন্ত্রাসবাদ— ছড়ানোতে লাগাম পরাতে চেষ্টার কসুর করেনি ভারত সরকার। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থাগুলি ইউজারদের নিরাপত্তার অজুহাতে আপত্তি করেই চলেছে। কিন্তু এ বার হয়তো তার শেষ হতে চলেছে। এমন আইন আসছে, যাতে ভারতীয় কোনও গোয়েন্দা সংস্থা চাইলে সংশ্লিষ্ট ইউজারের তথ্য দিতে বাধ্য থাকবে সংস্থাগুলি। তাতে কোনও ওয়ারেন্ট বা আদালতের নির্দেশও প্রয়োজন পড়বে না। এই মাসের শেষের দিকেই কার্যকরী হতে পারে সেই আইন।
আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে। ওই সময় এ নিয়ে অনলাইনে সাধারণ মানুষের মতামত চায় সরকার। যদিও ওই সময় ইন্টারনেট অ্যান্ড মোবাইল অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল, এই আইন সুপ্রিম কোর্টের ব্যাক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা সংক্রান্ত নির্দেশ লঙ্ঘন করা হবে। ফেসবুক, অ্যামাজন, অ্যালফাবেটের মতো সংস্থা এই অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য।
প্রসঙ্গত, ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি নিয়মগুলির সবশেষ পরিবর্তন নিয়ে বিতর্ক বেড়ে চলেছে। পরিস্থিতি এমন যেন, এবার থেকে সরকারই বলে দেবে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে কী থাকবে এবং কী থাকবে না। গত শুক্রবারের আইনি পরিবর্তন অনুসারে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর নেঈয়া মডারেশন সিদ্ধান্ত যাচাইবাছাই করতে তিন সদস্যের অভিযোগ নিষ্পত্তি কমিটি তৈরি করবে ভারত সরকার। এই প্যানেলটি তৈরি করবে ইলেকট্রনিক্স এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় তৈরি করবে। তারাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর বিষয়বস্তু সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে৷
এই বছরের শুরুতে পরিবর্তনগুলোর কথা সবাইকে জানানো হয়েছিল। প্রযুক্তি সংস্থাগুলি এবং জনসাধারণের জন্য নেয়া এই নীতির চরম বিরোধিতা করেছেন সমাজকর্মীরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর ব্যবহারকারীর অধিকার লঙ্ঘন করছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করে মন্ত্রণালয় নিজেদের পিঠ বাঁচিয়েছিল।
মন্ত্রণালয় বিশদ বিবরণ না দিয়ে জানিয়েছে, “বেশ কয়েকটি (প্রযুক্তি) মধ্যস্থতাকারী ভারতীয় নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করে কাজ করেছে।” একই সংশোধনী এখন আইনে রূপান্তরিত করে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে।
নতুন নিয়মে যা থাকছে
পরিবর্তিত নিয়ম বলছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে একদিনের মধ্যে ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে পাওয়া অভিযোগগুলোর প্রাপ্তি স্বীকার করতে হবে। দুই সপ্তাহের মধ্যে সেগুলোর সমাধান করতে হবে। তবে তথ্য সরানোর অনুরোধের ক্ষেত্রে ৭২ ঘণ্টার বিশেষ সময়সীমা পাওয়া যাবে।
মেটা এবং টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলির ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে সরকারের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার একটি অংশ এটি। একাধিক নামী প্রযুক্তি সংস্থার সঙ্গে এই নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে ভারত সরকারের।
২০২১ সালে তথ্যপ্রযুক্তির নিয়মগুলি কার্যকর হয়েছিল। এর ফলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনে পঞ্চাশ লাখেরও বেশি ব্যবহারকারীর রয়েছে এমন সামাজিক মাধ্যম থেকে পোস্টের উৎস শনাক্ত করা যাবে। এর ফলে নজরদারির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সরকার বর্তমানে দিল্লি হাইকোর্টে একটি মামলা লড়ছে যেখানে হোয়াটসঅ্যাপ ট্রেস সংক্রান্ত ধারাটি ব্লক করার আবেদন জানানো হয়েছে।
এরই মধ্যেসরকার জাতীয় নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকির কথা উল্লেখ করে ২০২১ সাল থেকে বেশ কয়েকটি টুইটার, ফেসবুক এবং ইউটিউব অ্যাকাউন্ট সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। ২০২২ সালের জুলাই মাসে, মাইক্রোব্লগিং ওয়েবসাইট টুইটার একই বিষয়ে একটি আঞ্চলিক উচ্চ আদালতে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। তারা অভিযোগ করেছে যে সরকার প্ল্যাটফর্ম থেকে নির্বিচারেবেশ কয়েকটি টুইট মুছে ফেলার আদেশ দিয়ে তার ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে।
তীব্র সমালোচনার মুখে
সাম্প্রতিক সংশোধনীগুলোসরকারকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণের বড়সড় সুযোগ করে দেবে। ভারতভিত্তিক ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশন এই নিয়মের তীব্র সমালোচনা করেছে।
সংস্থাটি একটি বিবৃতিতে বলেছে, “এটি মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জন্য একটি সরকারি সেন্সরশিপ। এর ফলে অনলাইনে আমাদের বাকস্বাধীনতার মধ্যস্থতাকারী হয়ে উঠবেন আমলারা। এটি নিঃসন্দেহে প্রত্যেক ভারতীয় সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর ডিজিটাল অধিকারকে আঘাত করবে।”
আইএফএফ একটি টুইটে জানায়, “বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজ, ডিজিটাল অধিকার গোষ্ঠী, শিল্প সংস্থা, প্রযুক্তিসংস্থা এবং সংবাদপত্রের সঙ্গে আমরাও ২০২১ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। ব্যবহারকারীদের ডিজিটাল অধিকারের ক্ষত আরো গভীর হয়েছে।”
এসডব্লিউ/এসএস/২০৪৫
আপনার মতামত জানানঃ