বেশ কয়েক বছর ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে (চবি) আঁকড়ে ধরেছে নেতিবাচক খবর, যার নেপথ্যে ছাত্রলীগ। নিত্য মারামারি, চাঁদাবাজি, ক্যাম্পাসের সবুজ পাহাড়ের গাছ কেটে পাচার, যৌন নিপীড়ন, ইয়াবা বিক্রি ও সেবন, হল দখল, চুরিসহ এমন কোনো অপরাধ নেই, যেখানে ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টতা নেই। এবার হলের সিট বরাদ্দে ছাত্রলীগের নৈরাজ্য ও অপক্ষমতার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আবেদন করার আগ্রহ কমে গেছে। ছাত্রলীগের ভয়ে হলেও উঠতে চাচ্ছেন না তারা।
প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, দীর্ঘ পাঁচ বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে আসন বরাদ্দ বন্ধ ছিল। নানা সমালোচনার মুখে গত ২২ সেপ্টেম্বর বরাদ্দ দিতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষ। গত রোববার আবেদনের সময়সীমা শেষ হলেও অর্ধেক আসনে থাকতে কোনো শিক্ষার্থী আগ্রহ দেখাননি। ৪ হাজার ৯২৫ আসনের বিপরীতে আবেদন জমা পড়েছে ২ হাজার ৭৮০টি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১১টি হল চালু রয়েছে। এবার সব বর্ষের শিক্ষার্থীকেই হলে থাকতে আবেদন করার কথা বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছিল। পরে ছাত্রদের সাতটি হলে ২ হাজার ৭২৫টি আসনের বিপরীতে আবেদন জমা পড়ে ১ হাজার ৬০টি। ছাত্রীদের চারটি হলে ২ হাজার ২৭০টি আসনের বিপরীতে আবেদন করেন ১ হাজার ৭২০ জন। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি আসনে থাকতে কোনো শিক্ষার্থী আবেদন করেননি।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, হলের আসন বরাদ্দের প্রক্রিয়া তিনটি ধাপে হয়। প্রথমে শিক্ষার্থীরা হল কার্যালয় থেকে ফরম সংগ্রহ করে আবেদন করেন। পরে হল প্রাধ্যক্ষ মৌখিক পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের আহ্বান করেন। এরপর শিক্ষার্থীদের আসন বরাদ্দ দেওয়া হয়।
নিয়ম মেনে সর্বশেষ ২০১৭ সালের জুনে হলগুলোতে আসন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। আসন বরাদ্দ না দিলেও শিক্ষার্থীরা যে হলে ছিলেন না, বিষয়টি এমন নয়। ছাত্রীরা হল কর্তৃপক্ষ থেকে সাময়িক অনুমতি নিয়ে ছিলেন। আর ছাত্রদের হলের আসন নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন শাখা ছাত্রলীগের নেতারা। তারাই হলের কোন কক্ষে কে থাকবেন, তা ঠিক করে দেন। বর্তমানে সব হলের সব আসনেই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা থাকছেন।
ছাত্রলীগ ও পুলিশ সূত্র জানায়, ছাত্রলীগের দুই সদস্যের কমিটি হওয়ার পর নেতাকর্মীদের মধ্যে অন্তত ৩৫ বার সংঘর্ষ হয়েছে। এসব সংঘর্ষের পেছনে ছিল হলের আসন দখল, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের চাঁদার ভাগবাটোয়ারা, আধিপত্য বিস্তার এবং ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ।
ছাত্রদের হলের আসন নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন শাখা ছাত্রলীগের নেতারা। তারাই হলের কোন কক্ষে কে থাকবেন, তা ঠিক করে দেন। বর্তমানে সব হলের সব আসনেই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা থাকছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে পারবে না হল কর্তৃপক্ষ। কারণ, এ ক্যাম্পাসের হলে কথায় কথায় মারামারি হয়। হলে কক্ষ দখল নিয়ে ছাত্রলীগের বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে গত পাঁচ বছরে ১৮ বার সংঘর্ষ হয়। কোনো শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হলে কর্তৃপক্ষ দায় নেবে না। সব দিক বিবেচনা করেই তারা আবেদন করেননি। মূলত ছাত্রলীগভীতিটাই মুখ্য।
ভীতির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন বলেন, আবেদন করতে কোনো শিক্ষার্থীকে বাধা দেওয়া হয়নি। আবেদন না করে এ ধরনের অভিযোগ করা ঠিক না।
নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন শিক্ষার্থী জাতীয় দৈনিককে বলেন, হলগুলোতে থাকতে হলে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হতে হবে। না হয় হলে থাকা যাবে না। এ ছাড়া হল কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে পারবে কি না, সেটি নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। মূলত এই অনাস্থার কারণেই তারা আবেদন করেননি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পাঁচ বছর আসন বরাদ্দ না দিয়ে কর্তৃপক্ষ দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। এ কারণে শিক্ষার্থীরা প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও হলের আসনের জন্য আবেদন করেননি। কারণ, এখন যারা হলে থাকছেন তাদের বের করে দিয়ে বরাদ্দ পাওয়া শিক্ষার্থীদের তোলার সক্ষমতা কর্তৃপক্ষের আছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। আবার হলে কোনো ঘটনা ঘটলে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে পারবে না কর্তৃপক্ষ।
তারা বলেন, প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা ক্ষমতাসীন দলের আস্থাভাজন। এ কর্তাব্যক্তিরা লাভের স্বার্থটাই বেশি খোঁজেন। স্বাভাবিকভাবেই তারা ক্ষমতাসীন দল ও ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের কাছে নতজানু হয়ে থাকেন। তাই ওই ছাত্রসংগঠনের কেউ আক্রান্ত হলে তাদের রক্ষা করার জন্য প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এ কারণে নেতা-কর্মীদের বেলায় এক ধরনের সক্রিয়তা, অন্য শিক্ষার্থীদের বেলায় অনেকটাই নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে কর্তৃপক্ষ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫০
আপনার মতামত জানানঃ