বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ১০টি পদের লিখিত পরীক্ষা ছিল গতকাল শুক্রবার। তবে পরীক্ষা শুরুর দেড় ঘণ্টা আগে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে আটক করে পুলিশ। পরে বিমান কর্তৃপক্ষ পরীক্ষাটি স্থগিত ঘোষণা করে। ফলে পরীক্ষার্থীরা কেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষা স্থগিতের বিষয়টি জানতে পারেন।
শুক্রবার বেলা তিনটা থেকে বিমানের জুনিয়র অপারেটর জিএসই, জুনিয়র টেইলর কাম আপহোলস্টার, জুনিয়র এয়ারকন মেকানিকসহ ১০টি পদের লিখিত পরীক্ষা ছিল। কেন্দ্র ছিল রাজধানীর উত্তরার নওয়াব হাবিবুল্লাহ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং আইইএস উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. যাহিদ হোসেন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘গোয়েন্দা পুলিশ থেকে বেলা দেড়টার দিকে আমাদের জানানো হয়, প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। এরপর বেলা দুইটার দিকে পরীক্ষার্থীরা কেন্দ্রে ঢোকার আগে আমরা পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা দিই।’
পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারী গ্রেপ্তার
নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) লালবাগ বিভাগ।
শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তাররা হলেন- আওলাদ হোসেন, মো. জাহাঙ্গীর আলম, এনামুল হক, মো. হারুন-অর-রশিদ ও মাহফুজুল আলম।
সন্দেহের তালিকায় ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে রোববার (২২ অক্টোবর) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, তাদের (গ্রেপ্তারকৃত) সঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিভিন্ন পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জড়িত আছেন। নিয়োগ পরীক্ষার তারিখ ঘোষণার পর থেকে তারা পরিকল্পনা শুরু করেন- কীভাবে প্রশ্নফাঁস করবেন এবং কীভাবে সেগুলো বিতরণ করবেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী পরীক্ষার আগের দিন ৪-৫ জন মিলে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নটি ফাঁস করেন। পরে সেগুলো টাকার বিনিময়ে সরাসরি ও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বিতরণ করেন। প্রশ্নগুলো তারা সর্বনিম্ন দুই লাখ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ সাত লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছে। এছাড়া গরিব পরীক্ষার্থীদের প্রশ্ন দিয়ে তারা নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে সই নিয়েছেন যে, তাদের বাড়ি কিংবা জমিজমা লিখে দেবে। গ্রেপ্তাররা এর আগেও বিভিন্ন প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
প্রশ্নগুলো তারা সর্বনিম্ন দুই লাখ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ সাত লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছে। এছাড়া গরিব পরীক্ষার্থীদের প্রশ্ন দিয়ে তারা নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে সই নিয়েছেন যে, তাদের বাড়ি কিংবা জমিজমা লিখে দেবে।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বলেন, এ নিয়োগ পরীক্ষার জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। কমিটির চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে প্রশ্নফাঁস হয়েছে সে রহস্য উদঘাটনের জন্য আমরা আসামিদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করব। গ্রেপ্তারদের সঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সুসম্পর্ক রয়েছে। সে বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করব।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বলেন, গ্রেপ্তাররা জানিয়েছে- এর আগেও কয়েকটি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করে তারা লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। সে টাকার ভাগ তারা আবার ওইসব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও দিয়েছেন। এসব বিষয়ে আমরা বিস্তারিত তথ্য জানার চেষ্টা করব গ্রেপ্তারদের কাছ থেকে।
কমিটিকে কীভাবে ফাঁকি দিল
তিনি আরও বলেন, তদন্তে আমরা আরও জানার চেষ্টা করব যে, এই প্রশ্নফাঁস চক্রটির সঙ্গে আর কারা কারা জড়িত। এছাড়া বিমানের ডিজিএম ও জিএমের সমন্বয়ে যে কমিটি গঠিত হয়েছিল, তাদের কাজ ছিল প্রশ্নফাঁসের মতো বিষয় রোধ করা। কিন্তু তাদের চোখের আড়ালে কীভাবে প্রশ্নফাঁস হলো- তা আমরা জানতে চাইব।
যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দিয়ে পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ নেওয়া হবে কিনা এবং বিমানের কমিটি প্রশ্নফাঁসের দায় নেবে কিনা জানতে চাইলে ডিবি প্রধান বলেন, পরীক্ষা কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করব। এছাড়া গ্রেপ্তারদের কাছ থেকেও রিমান্ডে আমরা এ বিষয়ে তথ্য জানার চেষ্টা করব।
চক্রটি এই প্রশ্ন কতজনের কাছে বিতরণ করেছিল এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্ত শেষে এ বিষয়ে আমরা সঠিক সংখ্যাটি জানাতে পারব।
অপর আরেক প্রশ্নের জবাবে ডিবি প্রধান বলেন, আমরা অভিভাবকদেরও বলেছিলাম- প্রশ্নফাঁসের মতো ঘটনা তাদের চোখের সামনে আসলে তারা যেন আমাদের জানায়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে কোনো অভিভাবক আমাদের তথ্য দেননি।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কমিটির গাফিলতি, নাকি সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরীক্ষা কমিটির কাজ হচ্ছে প্রশ্নপত্র ছাপানো থেকে শুরু করে নিরাপদে পরীক্ষা হলে পৌঁছানো। একইসঙ্গে পরীক্ষাটি সম্পন্ন করা। এই কমিটির চোখ ফাঁকি দিয়ে যেভাবে প্রশ্নফাঁস হয়েছে সেটি আমরা জানার চেষ্টা করব।
প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি থাকলে তাকে গ্রেপ্তার না করতে কোনো চাপ ডিবির ওপর থাকে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের সবাইকেই আমরা আইনের আওতায় আনি। কোনো তথ্য আসলে তা যাচাই-বাছাই করে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করি।
প্রশ্নফাঁসের অধিকাংশ মামলার ক্ষেত্রে দেখা যায়, মামলা আদালতে টেকে না। এক্ষেত্রে সঠিক ধারায় মামলা করা হয় কিনা এবং গতকাল কোন আইনে হয়েছে বা হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, আইন বিচার বিশ্লেষণ করে মামলা করা হচ্ছে- যাতে আসামিরা সর্বোচ্চ সাজা পান। আমরা প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনার আরও গভীরে যাবো।
প্রায় প্রতিটি বোর্ড পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস যেন বর্তমানে একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার ধরনটাও পাল্টে গেছে। পরীক্ষার আগে পড়াশোনা করার চেয়ে তারা বেশি ব্যস্ত ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের খোঁজে।
প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ, মিছিল প্রভৃতি অরাজকতা। উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকলেও দুর্নীতিতে শীর্ষে অবস্থান করছি আমরা, যা একটি জাতির জন্য অত্যন্ত অপমানজনক।
শিক্ষাবিদেরা বলছেন, অবিলম্বে প্রশ্নফাঁস বন্ধ করতে না পারলে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভেঙে পড়বে, মেধাহীন হবে জাতি। তারা বলছেন, প্রশ্ন ফাঁসের কারণে একদিকে যেমন দুর্বল মেধার শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করে এগিয়ে যাচ্ছে, অন্য দিকে যোগ্য লোক বঞ্চিত হচ্ছে তার কাঙ্ক্ষিত ফল ও চাকরি থেকে। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও মেধাবীরা কাঙ্ক্ষিত চাকরি না পাওয়ায় তাদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা। তাদের অনেকের নৈতিক স্খলন হয়ে জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। এদের একটি বড় অংশ হতাশা থেকে মুক্তির পথ খুঁজছে মাদকে। এই করুণ পরিণতি এখনি ঠেকাতে না পারলে ভয়াবহ সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৫২
আপনার মতামত জানানঃ