দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় গত ছয় দশকের বেশি সময় উৎপাদনে রয়েছে রাঙ্গামাটির কাপ্তাইয়ে অবস্থিত একমাত্র জল বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২৩০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্রটিতে এখন আর পূর্ণমাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে।
এ সংকটে যুক্ত হয়েছে হ্রদের পানিস্বল্পতা। যে কারণে গত এক দশকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন সক্ষমতা কমেছে ৩০ শতাংশেরও বেশি। সাধারণত বছরের ৩৬৫ দিনই ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎকেন্দ্র চললে সেটিকে শতভাগ প্লান্ট ফ্যাক্টর ধরা হয়। সেই হিসেবে ২০২১-২২ অর্থবছরে কাপ্তাই জল বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্লান্ট ফ্যাক্টর ছিল মাত্র ৩৩ শতাংশ।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) কেন্দ্রভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, কাপ্তাই জল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১৬০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ মিলছে না। এর মধ্যে গত দেড় বছরের কোনো কোনো সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে মাত্র ৩০ মেগাওয়াট। আবার দু-একদিন ১৭০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। তবে ওই সময়ে গড়ে উৎপাদন করেছে ১০০ মেগাওয়াটের কিছু বেশি।
বর্তমান এ সংকটের সময়ও কেন্দ্রটি দিয়ে ১৫০-১৬০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। সূত্র মতে, কাপ্তাই জল বিদ্যুৎকেন্দ্রে মোট পাঁচটি ইউনিট রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে পানির প্রবাহ বেড়ে গেলে সবক’টি ইউনিট সচল থাকে। কিন্তু পানি কমে গেলে কিংবা লেকের পানি ঠিক রাখতে কখনো কখনো দু-একটি ইউনিট বন্ধ রাখতে হয়। তবে কেন্দ্রটির চারটি ইউনিট পূর্ণমাত্রায় চললে ১৬০ মেগাওয়াটেরও বেশি বিদ্যুৎ পাওয়া যায় বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ক্রমবর্ধমান হারে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় জল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। একই সঙ্গে শীত মৌসুমে পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় তখন আর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। আবার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের কোনো কোনো ইউনিট বন্ধ রাখলে স্বাভাবিকভাবেই তখন উৎপাদন কম হয়।
জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি হাইড্রো পাওয়ার থেকে মূলত ২০ বছর পর্যন্ত বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। তবে যন্ত্রাংশ ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে মেয়াদকাল বাড়ানো যায়। বাংলাদেশের জল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হয় স্বাধীনতার আগে ষাটের দশকে। ২৩০ মেগাওয়াট সক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রটি সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করে একনাগাড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হলেও গত এক দশক ধরে এর সক্ষমতা কমতে শুরু করেছে। ফলে পাঁচটির মধ্যে অন্তত দুটি ইউনিট বছরের বেশির ভাগ সময় নানা কারণে বন্ধ রাখা হয়।
সব ধরনের উৎস থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের মধ্যে জলবিদ্যুৎই সবচেয়ে বেশি সাশ্রয়ী। তবে জল বিদ্যুৎকেন্দ্রের টারবাইন, জেনারেটর প্রতি বছরের নির্দিষ্ট একটি সময়ে মেরামত করার প্রয়োজন হয়। আর সেটি করা না হলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা কমে আসে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার করা গেলে বছরের তিন মাস অন্তত পূর্ণমাত্রায় বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব কাপ্তাই জল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। এছাড়া বছরের অন্যান্য সময় ১৮০ মেগাওয়াটের ওপরে উৎপাদন করা যাবে।
বিপিডিবি সূত্রে জানা গিয়েছে, কোনো জ্বালানি খরচ লাগে না বলে কাপ্তাই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির পাঁচটি ইউনিট ব্যবহার করা গেলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ পড়ে মাত্র ২০-২৫ পয়সা। আর চারটি ইউনিট চালানো গেলে খরচ পড়ে ৩৫-৪০ পয়সার মতো।
ফলে দেশের বিদ্যুৎ সংকটে কেন্দ্রটি পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করা গেলে সাশ্রয়ী হতে পারত বিদ্যুৎ বিভাগ। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ৪ ও ৫ নম্বর ইউনিটটি থেকে বর্তমানে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের কারণে কমানো হয়েছে উৎপাদন সক্ষমতা।
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শক্তি গবেষণার পরিচালক মো. শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী বলেন, জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে সাশ্রয়ী জলবিদ্যুৎ। পূর্ণমাত্রায় একটি জল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো গেলে প্রতি ইউনিট উৎপাদন খরচ ৪০-৫০ পয়সার মধ্যে রাখা যায়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে জল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্ভাব্যতা না থাকলেও বিদ্যমান বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আরো ১০০ মেগাওয়াট বাড়ানো যেতে পারে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৪৭
আপনার মতামত জানানঃ