ভারতের উচ্চ আদালত ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত পাঁচ ব্যক্তিকে জামিন দিয়েছে এই শর্তে যে তারা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ধর্ষিতাদের বিয়ে করবে। এগুলির মধ্যে এমন একজন ধর্ষিতাও আছেন, যার বয়স ঘটনার সময়ে ১৮ বছরের কম ছিল।
গত মাসখানেকের মধ্যেই পৃথক পৃথক মামলায় এই নির্দেশগুলি দেয় এলাহাবাদ হাইকোর্টের লক্ষ্ণৌ বেঞ্চ। এ প্রসঙ্গে ধর্ষণের শিকার হওয়া নারী ও আইনজীবীরা বলছেন, ধর্ষিতাকে বিয়ে করার শর্তে অভিযুক্ত কখনই জামিন পাওয়ার উপযুক্ত হতে পারে না।
উল্লেখ্য, এধরণের সর্বশেষ নির্দেশটি দেওয়া হয় ১০ অক্টোবর। এলাহাবাদ হাইকোর্টের লক্ষ্ণৌ বেঞ্চের বিচারক দীনেশ কুমার সিং তার নির্দেশে জানিয়েছেন যে এবছরের এপ্রিল মাস থেকে জেলে আটক ধর্ষণে অভিযুক্ত মনুকে জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় বিবেচনা করা হয়েছে।
প্রথমত নির্যাতিতা এবং তার বাবা জামিনের বিরোধিতা করেননি, আর দ্বিতীয়ত, ওই নারী ইতিমধ্যেই অভিযুক্তের সন্তানের জন্ম দিয়েছেন।
আদালতের নির্দেশে বলা হয়েছে, “জেল থেকে বেরনোর ১৫ দিনের মধ্যেই মনু ওই নারীকে বিয়ে করবেন, আর সেটি নথিভুক্ত করবেন, এই শর্তে জামিন দেওয়া হল। ওই নারী এবং তার সন্তানকে স্ত্রী এবং কন্যার সব ধরণের অধিকার দেবেন মনু, এটাও নির্দেশে জানিয়েছেন ওই বিচারক।
ঘটনাচক্রে যে ধর্ষণের ঘটনায় মনুকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, সেই সময়ে নির্যাতিতার বয়স ছিল ১৭। সেজন্যই অপ্রাপ্তবয়স্কদের যৌন অপরাধের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য যে আইন আছে, সেই পক্সো আইনেই মনুর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল।
আইনী অনুমোদন নেই
তবে এটাই প্রথম নয়, ভারতের একাধিক আদালত নানা সময়ে ধর্ষণে অভিযুক্তদের সঙ্গে ধর্ষিতা নারীর বিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কলকাতা হাইকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ভারতী মুৎসুদ্দি বলেন, “আইনে এমন কোনও জায়গা নেই যার মাধ্যমে ধর্ষিতাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিলে ধর্ষণে অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিন পেয়ে যেতে পারবেন।”
“তবুও অনেক সময়েই আমরা দেখি জজ সাহেবরা এধরণের নির্দেশ দিয়ে থাকেন। আসলে তাদের মনে সম্ভবত এই চিন্তাটা কাজ করে যে ধর্ষিতা নারী যেন সামাজিক ভাবে পুনর্বাসন পায়, সে যেন সমাজচ্যুত না হয়ে পড়ে।”
“তবে অনেক সময়েই দেখা গেছে ওই তথাকথিত বিয়ের কিছুদিন পরে অভিযুক্ত ব্যক্তি ওই নারীকে ত্যাগ করে চলে গেছেন, অথবা সেই বিয়ের পরেও মেয়েটিকে নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে কাটাতে হচ্ছে।”
ধর্ষিতা নারীর মানসিক অবস্থা
নারী অধিকার রক্ষা আন্দোলনের কর্মীরা বলেন, কোনও নারী যখন ধর্ষিতা হন, সেই সময় থেকেই শুরু হয় একের পর এক ভয়াবহ মানসিক আঘাত। দ্বিতীয় আঘাত আসে বিচারালয়ে বারে বারে যখন তাকে ধর্ষণের ঘটনার বর্ণনা দিতে হয়।
এসবের পরেও যদি এরকম কাউকে তাকে বিয়ে করতে বলা হয় যে ব্যক্তি তার ওই মানসিক আঘাতগুলির জন্য দায়ী, তা যে কোনও নারীর পক্ষেই যেমন অপমানকর, তেমনই সেই ঘটনা তার মনে চিরস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করেন নারী আন্দোলনের কর্মীরা।
ধর্ষিতা নারীদের কাউন্সেলিং করানো শান্তশ্রী চৌধুরী বলেন, “আমাদের সমাজে মেয়েদের কথা আর কে শুনেছে! ধর্ষিতা নারীদের কি আর কোনও কথা বলার জায়গা থাকে? তার বাবা বা সমাজ অথবা কোর্ট যা বলছে, সেটাই তাদের মেনে নিতে হয়। সেজন্যই ধর্ষককেও যদি বিয়ে করতে বলা হয়, সে সেটাই মেনে নিতে বাধ্য হয়। তার মানসিক অবস্থার দিকে তো আর কারও নজরই থাকে না।”
তার কথায়, “বহু ঘটনায় দেখেছি, অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েরা রেপড হওয়ার পরে আমার কাছে এসে হাউ হাউ করে কাঁদছে, আবার কিছুদিন পরে সেই ধর্ষককেই বিয়ে করতে সে বাধ্য হল।”
“অনেক সময়েই কিছুদিন পরে, হয়তো একটা সন্তানের জন্মের পরেই সেই অভিযুক্ত মেয়েটিকে ত্যাগ করে চলে গেল। তখন কিন্তু ধর্ষণে অভিযুক্তকে বিয়ে করার নিদান দিয়েছিল যে রাষ্ট্র, সে আর মেয়েটির পাশে এসে দাঁড়ায় না।”
জামিন পাওয়ার জন্য বিয়ের প্রতিশ্রুতি
আইনজীবী এবং নারী অধিকার কর্মীরা বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষণে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা জামিন পাওয়ার যুক্তি হিসাবে ধর্ষিতাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন আদালতে। কিছু ক্ষেত্রে অর্থের বিনিময়ে বা সামাজিক প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়েও ধর্ষিতার পরিবারের ওপরে বিয়েতে মত দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়।
কিন্তু সেই অভিযুক্ত বা তার পরিবার বিয়ের পরে ধর্ষিতার ওপরে অত্যাচার চালাচ্ছে কিনা; এরকম কোনও নজরদারি চালানো হয় না।
আইনজীবী ভারতী মুৎসুদ্দির বলেন, “এটা অনেকটা যেন সালিশি ব্যবস্থা। আদালত তো আর সালিশি করার জায়গা না। আইনে তো এরকম কোনও প্রভিশান নেই। চরম শাস্তির ব্যবস্থা না করে কেন অভিযুক্তকে জামিন দেওয়া হবে, আর এই গ্যারান্টি কি আদালত দিতে পারে যে জামিন পেয়ে ওই ব্যক্তি আবারও একই কাজ করবে না?”
বিশেষজ্ঞদের মতে, এলাহাবাদ হাইকোর্টের লক্ষ্ণৌ বেঞ্চের পর পর কয়েকটি রায় এখন আলোচনায় উঠে এলেও আদালতের বাইরেও ধর্ষণে অভিযুক্তর সঙ্গে ধর্ষিতা নারীর বিয়ে দিয়ে দেওয়ার চল ভারতের সমাজে রয়েছে। বিশেষ করে গ্রামের দিকে এর চল রয়েছে বলে নানা সময়ে সংবাদ প্রতিবেদন চোখে পরে।
ওই সব ক্ষেত্রে সমাজের মাথারা দুই পরিবারের মধ্যে মধ্যস্থতা করেন। তাদের যুক্তিগুলো থাকে, ধর্ষিতা নারীকে অন্য কেউ বিয়ে করতে রাজী হবে না অথবা ধর্ষিতার পরিবারের সামাজিক সম্মান নষ্ট হবে ইত্যাদি। কোনও ক্ষেত্রেই ধর্ষিতা নারীর কথা শোনা হয় না, যে সে আদৌ তার ধর্ষককে বিয়ে করতে চায় কী না।
এসডব্লিউ/এসএস/১১৫৮
আপনার মতামত জানানঃ