প্রতিবছর নানা কারসাজিতে কী পরিমাণ অর্থ দেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, তার হিসাব সরকারের কাছে নেই। যখন বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সূত্রে এসব পাচারের খবর চাউর হয়ে যায় কিংবা বাজারে ডলার-সংকট দেখা দিলে কর্তাব্যক্তিরা নড়েচড়ে বসেন। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ‘কঠোর ব্যবস্থা’ নেওয়ার আওয়াজ দিতে থাকেন। তারপর সবকিছু আগের মতো চলতে থাকে বা চলতে দেওয়া হয়।
সম্প্রতি ডলার-সংকটের প্রেক্ষাপটে সরকার অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের দাবি, সারা দেশে অবৈধ ৭০০ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করছে।
বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগে ঢাকার তিনটি মানি এক্সচেঞ্জের মালিকের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একটি মামলায় এক ব্যবসায়ীর ১৪ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। তিনি ১২ কোটি টাকা পাচারের সময় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
যেখানে দেশে বৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান আছে ২৩৫টি, সেখানে ৭০০ অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান কীভাবে এত দিন ব্যবসা করল? আবার যেসব মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান সরকারের অনুমোদন নিয়ে ব্যবসা করছে, তাদের সততাও পরীক্ষিত নয়। কঠিন সত্য হলো মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমেই বিদেশে যে অর্থ পাচার হয়, তার কয়েক গুণ বেশি অর্থ পাচার হয় ‘অন্য উপায়ে।’
বিশেষ করে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী রপ্তানি পণ্যের দাম কম দেখিয়ে এবং আমদানি পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে অর্থ পাচার করে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বিবিসিকে বলেন, দেশের বাইরে যখন টাকা পাচার হয়, তখন কৃত্রিমভাবে ডলারের দাম বেড়ে যায় এবং দেশের মুদ্রা অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি বলছে, ২০১৫ সালে বাণিজ্য কারসাজির মাধ্যমে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ বিদেশে পাচার হয়েছে।
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ বছরের মাঝামাঝি প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালে সেখানকার ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ ৫ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা।
মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিক্ষিপ্ত অভিযান চালিয়ে অর্থ পাচার ঠেকানো যাবে না। সার্বক্ষণিক নজরদারি জারি রাখতে হবে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে সরকার।
কিন্তু তাদের জানা উচিত যে বিদেশে একবার অর্থ পাচার হলে, সেটি ফেরত আনা খুবই কঠিন কাজ। বরং সরকারকে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে কেউ বিদেশে অর্থ পাচার করতে না পারে।
সিআইডির দায়ের করা সে মামলায় বলা হয়েছে, যুবলীগের সাবেক নেতা ইসমাইল হোসেন চোধুরী ওরফে সম্রাট সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় প্রায় ২০০ কোটি টাকা পাচার করেছেন। সেই মামলার বিচার হওয়ার আগেই তিনি ‘কারামুক্ত’।
একদিকে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান, অন্যদিকে চিহ্নিত অর্থ পাচারকারীদের ছাড় দেওয়া যেমন স্ববিরোধিতা, তেমনি সরকারের অর্থ পাচারবিরোধী অভিযানের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে।
অর্থ পাচারের দায়ে যারা ধরা পড়েছেন, তাঁদের যথোচিত শাস্তি হোক, এটা সবাই চায়। একই সঙ্গে যারা নানা কারসাজির মাধ্যমে অর্থ পাচার করে ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন, তাদের পাকড়াও করার চেষ্টাও অব্যাহত রাখতে হবে। চুনোপুঁটিদের ধরে রাঘববোয়ালদের ছেড়ে দিলে অর্থ পাচার কখনোই বন্ধ হবে না।
কেন অর্থ পাচার করা হয়?
অর্থ পাচারের পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে। এ বিষয়ে গবেষক ও বিশ্লেষকদের আলোচনা থেকে যা পাওয়া যায়, সংক্ষেপে তাহলো— ক) যারা অর্থ পাচার করছেন, তারা দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ পাচ্ছেন না। খ) ব্যবসায়ী প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় টিকে থাকতে পারছেন না। গ) বাংলাদেশের ভবিষ্যতের প্রতি তাদের আস্থা নেই। ঘ) অন্যায়ভাবে বা দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ ব্যবহারের সুযোগ তৈরির জন্য অর্থ পাচার করা। ঙ) রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতাও একটি কারণ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে পাঁচ কারণে টাকা পাচার হচ্ছে। দেশে বিনিয়োগের পরিবেশের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার শঙ্কা, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর দুর্বল নজরদারি, আইনের শাসনের ঘাটতি এবং বেপরোয়া দুর্নীতি। বাজেটে দেখা যাচ্ছে অর্থ পাচারের পেছনে যৌক্তিক ও অযৌক্তিক বা ন্যায়/অন্যায় উভয় ধরনের কারণ থাকতে পারে।
দেশ থেকে অর্থ পাচারের নেপথ্য কারণ কি- এ নিয়ে দৃশ্যমান কোনো গবেষণা বা তথ্য নেই। সরকারের কাছে হয়তো আছে, তবে তা প্রকাশ করা হয়নি। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দুই কারণে অর্থ পাচার করা হয়। এর মধ্যে প্রধান এবং প্রথম কারণ দুর্নীতি (দৈনিক যুগান্তর, ১০ জুন, ২০২১)। অর্থ পাচার রোধে বাংলাদেশের ভূমিকা দুর্বল হওয়ার কারণগুলো—
সরকারের সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা
গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, গত বছর দুদক ৪৩ জনের নামসহ একটি কমপ্লায়েন্স রিপোর্ট আদালতে জমা দিয়েছে। এতে তাদের নিজস্ব কোনো অনুসন্ধান ছিল না। এখন প্রশ্ন হলো: তারা কেন এটা করল না? দুদকের আইনজীবীর ভাষ্য, অর্থ পাচারকারীদের ব্যাপারে তারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে চেয়েও কোনো তথ্য পায়নি। প্রশ্ন আসে: কেন এমন হলো? পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, অর্থ পাচারকারীদের অনুসন্ধান তার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নয়।
আন্তর্জাতিক সমন্বয় ঘাটতি
বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থের বৃহৎ গন্তব্য সুইজারল্যান্ডের সুইস ব্যাংক। কিন্তু এ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ নিয়মিত বিস্তারিত তথ্য পাওয়ার জন্য এখন পর্যন্ত সুদৃঢ় কোনো সমঝোতা চুক্তি নেই।
আন্তর্জাতিক সমস্যা
অর্থ পাচার রোধ করতে আন্তর্জাতিক একটি সমস্যা আছে। অর্থ পাচারের দুটি দেশ থাকে। একটি উৎস দেশ। আরেকটি গন্তব্য দেশ। এটি ভালোভাবে রোধ করতে হলে শুধু উৎস দেশ এককভাবে সক্রিয় হলে শতভাগ কার্যকর হয় না। গন্তব্য দেশও একে প্রশ্রয় না দেয়ার ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। বাস্তবতা হলো উন্নত দেশগুলো যেগুলো অর্থ পাচারের গন্তব্য দেশ-তারা এ ব্যাপারে সহনীয়। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই তাদের দেশে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে পাচারকৃত অর্থকে স্বাগত জানায়। এটিই সত্য।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৫০
আপনার মতামত জানানঃ