১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৬-০৭-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে মূল দুটো রাজনৈতিক দলই চাতুর্যপূর্ণ চাল-পাল্টা চালে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চেষ্টা করেছে। এবারও এক্স ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
এর শুরু আরও আগে থেকেই। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচন পর্যন্ত চারটি সংসদ নির্বাচনেই (১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বাদে) বাংলাদেশের জনগণ ক্ষমতাসীন দল বা জোটকে প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে পতিত স্বৈরাচারী এরশাদের নির্বাচনী বিপর্যয় প্রত্যাশিত ছিল, কিন্তু ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনগুলোতে ভোটের মাধ্যমে জনসমর্থন পেয়ে নির্বাচিত ক্ষমতাসীন দল বা জোটের প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে তাদের প্রতি চপেটাঘাতের শামিল। ১৯৯১ সালে বিজয়ী বিএনপি নির্বাচনে কারচুপি করতে গিয়ে মাগুরায় ধরা খেয়ে যায়, যার পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার আন্দোলন জোরদার এবং সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে কেন্দ্র করে আবারও আবর্তিত হচ্ছে সেই বিএনপির রাজনীতি। তবে কতটা সম্ভব তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই সময়ে এসে? নাকি এটা শুধুই বিএনপির আকাশ কুসুম কল্পনা?
এই দ্বন্দ্বের মাঝেই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এখন সংলাপ করছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংলাপে তিনি আন্দোলনের কর্মসূচি এবং দাবি-দাওয়া নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছেন বলে ঘোষণা করেছেন। গতকাল দুটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেছেন। এই সংলাপের পর গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন যে, আগের সংবিধানে যে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছিল তা ফিরিয়ে আনতে হবে।
এটি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং আইনজ্ঞদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। আগের তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা কি ফিরিয়ে আনা সম্ভব? চলুন বিষয়টা নিয়ে ভেবে দেখা যাক।
বাংলাদেশের সংবিধানে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রধান দাবি ছিল নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। কিন্তু সেই সময় সংবিধানে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু গণআন্দোলনের মুখে হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হন।
এরশাদ পদত্যাগ করলে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ প্রথমে ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং পরবর্তীতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান। তখন প্রেক্ষাপটটি ভিন্ন রকম ছিল। সেই সময়ে রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা দেশে বিদ্যমান ছিল। যার ফলে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের পর বিচারপতি শাহাবুদ্দিন নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণে কিছু সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা থাকলেও সেটি পুরোপুরি সংবিধান লঙ্ঘন ছিল না।
কারণ, পরবর্তীতে একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠানকে বৈধতা দেওয়া হয় এবং বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ পরবর্তীতে স্বপদে ফিরে যান। যদিও এক্ষেত্রে সংবিধানের কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং ব্যত্যয় ঘটেছিলো। কিন্তু তারপরও একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এটিকে একটি বৈধতা দেওয়া হয়েছিলো।
এরপর ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। বিএনপি ক্ষমতায় এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তন বা সংবিধানে সন্নিবেশিত করতে অস্বীকৃতি জানায়। এসময় আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ উপনেতা আব্দুস সামাদ আজাদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তন সংক্রান্ত একটি বিল সংসদে উত্থাপন করলেও সরকারি দলের আপত্তির মুখে তা নাকচ হয়ে যায়।
আওয়ামী লীগ মাগুরা এবং মিরপুর নির্বাচনের পর নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উপস্থাপন করতে থাকে এবং এর প্রেক্ষিতে ১৯৯৪ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতি তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করেন।
এই রূপরেখা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ আন্দোলন শুরু করে। তখন বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। এমনকি বেগম খালেদা জিয়া এটিও বলেন যে, একমাত্র পাগল এবং শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কোনোক্রমে গ্রহণ করা হবে না বলে বিএনপি নেতারা সরাসরি ঘোষণা করেছিলেন। এর প্রেক্ষিতে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি নির্বাচনের ডাক দেয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করে।
পরবর্তীতে বিএনপি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে সংযুক্ত করতে বাধ্য হলে তাদের গঠিত সংসদ ভেঙে দেয়া হয় এবং নতুন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া হয়। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশে দ্বিতীয় এবং সাংবিধানিকভাবে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে। এরপরে সংবিধানের বিধান মতে দ্বিতীয় দফা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে এসময় আওয়ামী লীগ শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে। কিন্তু আবার ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
এসময় বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসেবে বিচারপতি কে এম হাসানকে করার জন্য সংবিধান সংশোধন করে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দলীয় সরকারে রূপান্তরিত করে। কে এম হাসান শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে অস্বীকৃতি জানালে ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বানানো হয় এবং পুরো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকেই বিতর্কিত করা হয়।
এরকম বাস্তবতায় দেশে এক-এগারো আসে এবং সেনাসমর্থিত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কায়েম করা হয়। এর মধ্যেই বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক হিসেবে ঘোষণা করেন এবং এটি বাতিল করার নির্দেশনা প্রদান করেন।
একই সাথে সুপ্রিম কোর্ট অন্য একটি রায় ৭২ এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তনের নির্দেশনা দেন। এই প্রেক্ষিতে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ৭২ এর সংবিধানের ধারায় ফিরে যায় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে।
অনেক বিশেষজ্ঞের প্রশ্ন হলো, সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যেটি আদালতের নির্দেশে বাতিল হয়েছে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব? সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ হলো আওয়ামী লীগ। কাজেই আওয়ামী লীগ যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাহলে সংবিধান সংশোধন কিভাবে সম্ভব?
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৫৫
আপনার মতামত জানানঃ