চীনে ভালো নেই উইঘুর মুসলিমরা। সে দেশে নানা অত্যাচারের মধ্যে পড়তে হয়। এমনকি নানা রকমের বিধি নিষেধের মধ্যে পড়তে হয় উইঘুর মুসলিমদের। আর তা নিয়ে বারবার প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে চীনের প্রশাসনকে। কার্যত বিশ্বের তোপের মুখে পড়তে হয়।
এবার এই ইস্যুতে আলোচনা হলো বিশ্বের সবথেকে বড় মঞ্চ জাতিসংঘে। সেখানের মানবাধিকার পরিষদে এই প্রসঙ্গে একটি ভোটাভুটি হয়। বিশেষ অশান্ত জিংজিয়াং অঞ্চলে মানবাধিকারি পরিস্থিতি নিয়ে একটা খসড়া প্রস্তাবের উপর ভোটাভুটি হয়।
৪৭ সদস্যের পরিষদে খসড়া প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট দেয় ১৭ টি দেশ। বিপক্ষে ভোট দেয় পাকিস্তান, আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া,মালয়েশিয়া, চীন-সহ ১৯টি দেশ। অন্যদিকে, ভারত, ব্রাজিল, মেক্সিকো এবং ইউক্রেন-সহ ১১টি দেশ ভোটদান থেকে বিরত থাকে।
আর প্রস্তাবের বিরুদ্ধে যেসব দেশ ভোট দিয়েছে তারা হলো বলিভিয়া, ক্যামেরন, চীন, কিউবা, ইরিত্রিয়া, গ্যাবন, ইন্দোনেশিয়া, আইভরিকোস্ট, কাজাখস্তান, মৌরিতানিয়া, নামিবিয়া, নেপাল, পাকিস্তান, কাতার, সেনেগাল, সুদান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, উজবেকিস্তান ও ভেনিজুয়েলা। ভোটদানে বিরত থাকে আর্জেন্টিনা, আর্মেনিয়া, বেনিন, ব্রাজিল, গাম্বিয়া, ভারত, লিবিয়া, মালাবি, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো ও ইউক্রেন।
বলা হচ্ছে, এক্ষেত্রে কড়া লবিং করেছে চীন। আর তাদের এই লবিংয়ের ফলে যে ঘটনা ঘটলো তাকে দেখা হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য বড় রকম এক আঘাত হিসেবে।
গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা চীনকে টার্গেট করে জাতিসংঘের অধিকার বিষয়ক পরিষদে একটি খসড়া প্রস্তাব আনে। এতে ন্যূনতমপক্ষে জিনজিয়াংয়ের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করে তারা। এই জিনজিয়াং প্রদেশেই বসবাস উইঘুর মুসলিমদের।
জাতিসংঘের অধিকার বিষয়ক সাবেক প্রধান মিশেল ব্যাচেলে জিনজিয়াং পরিস্থিতি নিয়ে তার বিলম্বিত রিপোর্ট প্রকাশের পর তা আলোচনার উদ্যোগ নেয় যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্ররা। ওই রিপোর্টে চীনের সর্বপশ্চিমাঞ্চল জিনজিয়াংয়ে বসবাসকারী উইঘুর ও অন্য মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে মানবাধিকারের বিরুদ্ধে অপরাধ হয়ে থাকতে পারে এমনটা দাবি করা হয়।
পশ্চিমা দেশগুলো মনে করেছিল তারা জাতিসংঘের ওই রিপোর্ট নিয়ে সাদামাটাভাবে শুধু আলোচনা করবে। ফলে অন্য দেশগুলো এতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না।
কিন্তু ৪৭ সদস্যের জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে এ প্রস্তাব নিয়ে যেন ক্ষুরধার এক নাটকীয়তা জমে ওঠে। জিনজিয়াং ইস্যুতে বিতর্ক আটকে দেয়ার জন্য প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ১৯-১৭ ভোট পড়ে। এতে ভোটদানে বিরত ছিল ১১টি দেশ।
এরপরই চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনিং টুইটে বলেছেন, এই বিজয় উন্নয়নশীল দেশগুলোর। এই বিজয় সত্য ও ন্যায়বিচারের।
এই ভোটকে একপেশে, প্রতারণার বলে অভিহিত করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। অন্যদিকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, এর মধ্য দিয়ে নির্যাতিত মুসলিমদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে।
পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মিশেলে টেইলর টুইটে বলেছেন, জিনজিয়াং নিয়ে আলোচনা প্রতিরোধ করার জন্য যে ভোটে যা হলো তার নিন্দা জানায় যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্য দিয়ে কিছু দেশকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে।
জিনজিয়াং নিয়ে আলোচনা প্রতিরোধ করার জন্য যে ভোটে যা হলো তার নিন্দা জানায় যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্য দিয়ে কিছু দেশকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে।
ওদিকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বিবৃতিতে বলেছেন, ওয়াশিংটন এবং কিছু পশ্চিমা দেশ জিনজিয়াংকে ব্যবহার করছে গুজব ছড়াতে এবং সমস্যা সৃষ্টি করতে। মানবাধিকারের ছদ্মাবরণে তারা রাজনৈতিক ইস্যুতে যুক্ত হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে চীনের ভাবমূর্তি নষ্ট করে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং কিছু পশ্চিমা দেশের ষড়যন্ত্র আরও একবার ব্যর্থ হয়েছে। জিনজিয়াং সংশ্লিষ্ট ইস্যু মৌলিক অর্থেই মানবাধিকার বিষয়ক ইস্যু নয়। এ ইস্যু সন্ত্রাস বিরোধী, উগ্রপন্থাবিরোধী এবং বিচ্ছিন্নতাবিরোধী।
যুক্তরাষ্ট্র যাদেরকে সঙ্গে নিয়ে এই প্রস্তাবের খসড়া করেছিল তারা হলো অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, নরওয়ে, সুইডেন, তুরস্ক ও অন্যান্য দেশ।
মিশেল ব্যাচেলের রিপোর্ট প্রকাশ হয় তার ক্ষমতার মেয়াদের একেবারে শেষপ্রান্তে ৩১শে আগস্ট। এতে তুলে ধরা হয় জিনজিয়াংয়ে বসবাসকারী উইঘুর মুসলিমদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ নির্যাতন, খেয়ালখুশিমতো আটকে রাখা, ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘন এবং সন্তান জন্মদানের অধিকার লঙ্ঘনের বিশ্বাসযোগ্য রিপোর্ট।
দীর্ঘদিন চীনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আছে। ফলে জাতিসংঘ এই অভিযোগ আমলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে জোর দিয়ে এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে বেইজিং। তারা বলেছে, ওই অঞ্চলে সন্ত্রাস মোকাবিলায় তারা ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ সেন্টার পরিচালনা করছে।
যদিও শেষমেশ প্রস্তাবটি পরিষদে গৃহীত হয়নি। তবে এই বিষয়টি নিয়ে আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ চাইনার ডিরেক্টর সোফি রিচার্ডসন। বিশ্বের সবথেকে বড় মানবাধিকার মঞ্চ মানবাধিকার পরিষদে চীনে উইঘুর মানুষদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাব গুরুত্ব দিয়ে দেখল। যদিও প্রস্তাবটি গ্রহণ করতে পারিনি কাউন্সিল।
কিন্তু আশার আলো একটা তৈরি হল বলে মনে করছেন ডিরেক্টর সোফি রিচার্ডসন। দিনের পর দিন চলে আসা উইঘুর মুসলিম মানুষের উপর অত্যাচার বন্ধে চীন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, চীন যেভাবে অধিকার লঙ্ঘন করছে তা নিয়ে কথা বলতে ধীরে ধীরে একাধিক দেশ এগিয়ে আসছে বলেও দাবি হিউম্যান রাইটস ওয়াচ চাইনার ডিরেক্টর। যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৬
আপনার মতামত জানানঃ