২০২৩ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা সম্ভব নয়। এমনকি নতুন নির্ধারিত সময়সীমা অনুযায়ী রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ২০২৪ সালে থাকলেও, সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির আওতায় সঞ্চালন লাইন নির্মাণ সম্পন্ন না হওয়ায় এই বিদ্যুৎ সে সময়ের মধ্যে জনগণের কাছে পৌঁছাবে বলে মনে হয় না।
সূত্র মতে, সঞ্চালন লাইনের মধ্যে দুটি নদী পার হওয়ার বিষয় রয়েছে। সেই কাজটি ঠিকভাবে করে সময়মতো লাইন প্রস্তুত করা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। সবকিছু বিবেচনায় নিলে আমরা আশা করতে পারি যে ২০২৫ সালে এ বিদ্যুৎ জনগণ ব্যবহার করতে পারবে।
এ সময় প্রথম ইউনিট থেকে প্রায় ১২০০ মেগাওয়াট ও তার পরের বছর দ্বিতীয় ইউনিট থেকে প্রায় ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। বর্তমানের বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবিলায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এ সময়ের মধ্যে অবশ্য বেশ কিছু বড় কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে।
তবে এর থেকে বড় চিন্তার বিষয় এই পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. বদরূল ইমাম বলেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বিশেষ আলোচনায় আসার কারণ হলো পারমাণবিক দুর্ঘটনা অন্য যেকোনো দুর্ঘটনার চেয়ে অধিকতর ক্ষতিকর, ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। বিশ্বে অতীতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বড় আকারের দুর্ঘটনা ঘটার দৃষ্টান্ত রয়েছে। চেরনোবিল ও ফুকুশিমা ইত্যাদির কথা বলা যায়। তারপরও বিশ্বের বহু দেশ দুর্ঘটনারোধী প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রেখেছে।
ঝুঁকি রোধের কার্যকারিতা নির্ভর করে কতটা উন্নত আধুনিক ঝুঁকিরোধী প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলো এবং এই প্রযুক্তি ব্যবহারে জনবলের কারিগরি দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কত তার ওপর। বাংলাদেশের নিজস্ব কারিগরি দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাব এ ক্ষেত্রে একটি দুর্বলতা বটে। যেকোনো দুর্ঘটনাজনিত বা বিপৎকালীন পরিস্থিতিতে পুরোপুরি বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হলে দেশীয় মহলে একটি সংশয় থেকেই যায়।
তিনি বলেন, পৃথিবীতে বাংলাদেশের মতো এত ঘনবসতিপূর্ণ কোনো দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে বলে আমার জানা নেই। রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের আগে এর ফিজিবিলিটি স্টাডি করার সময় বিষয়টি বিবেচনায় আনা হয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস। তবে আমাদের দেশের মতোই পরিবেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের। ভারত সরকার সেখানে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তা নাকচ করে দেয়।
এ ধরনের প্রকল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিপৎকালীন ইভাকুয়েশন প্ল্যান বা নিরাপদ স্থানান্তর পরিকল্পনা। কখনো কোনো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিকভাবে আশপাশের লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হয়। সাধারণ ব্যবস্থাপনায় এ রকম দুর্ঘটনা ঘটলে ছড়িয়ে পড়া তেজস্ক্রিয়তার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য লোকজনকে তাৎক্ষণিকভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রে থেকে অন্তত ২০ কিলোমিটার দূরে সরিয়ে নিতে হয়।
পাবনার রূপপুরের আশপাশের এলাকা দেশের অন্যান্য এলাকার মতোই ঘনবসতি পূর্ণ। এমন বাস্তবতায় কোনো সংকট দেখা দিলে আশপাশের জনগোষ্ঠীকে কীভাবে, কোথায় ও কত তাড়াতাড়ি অন্যত্র সরানোর ব্যবস্থা করা যাবে কিংবা কীভাবে সেই প্রস্তুতি নেওয়া হবে, তার কোনো তথ্য নেই। এ বিষয়ে স্থানীয় জনগণকে সচেতন করাও জরুরি।
তিনি বলেন, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজে নিয়োজিত রাশিয়ার পারমাণবিক সংস্থা রোসাটমের তথ্য অনুযায়ী রূপপুরে স্থাপিত পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর দুটি থার্ড জেনারেশন প্লাস শ্রেণির অত্যাধুনিক ভিভিআর-১২০০ মডেলের। এসব রিঅ্যাক্টরে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা রয়েছে। রোসাটমের মতে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঝুঁকি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
কিন্তু কথা হলো দুর্ঘটনা সব সময়ই আকস্মিকভাবে ও অপ্রত্যাশিতভাবে আসে, কখনোই ঘোষণা দিয়ে আসে না। রূপপুরের প্রযুক্তি অত্যাধুনিক হতে পারে। তবে তা নিশ্চয়ই চাঁদে যাওয়া-আসা করা অ্যাপোলো চন্দ্রযানগুলোর প্রযুক্তির সমকক্ষ নয়। নাসা পরিচালিত একটি অ্যাপোলো যানও তো চাঁদে যাওয়ার পথে একবার দুর্ঘটনায় ধ্বংস হয়ে যায়। আসলে নিশ্ছিদ্র নিরাপদ বলে কিছু নেই। আর আমাদের সমস্যা বেশি, কারণ আমরা তথ্য আদান–প্রদান বা তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে খুবই দুর্বল।
রূপপুর বাংলাদেশের এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। কিন্তু এটি নিয়ে তো সংসদে কোনো আলোচনা বা বিতর্ক শুনি না। এর ভালো–মন্দ প্রশ্নে ব্যাপক জনসচেতনতা নেই, বিশেষ করে যে এলাকায় এটি হতে যাচ্ছে, সেখানকার জনগণের মধ্যে সচেতনতা কতটুকু, তা এক বড় প্রশ্ন।
শতভাগ বিদেশ নির্ভরতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পর এটি পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন রাশিয়ানরা। এ ছাড়া ভারতীয় একটি দল কোনো কোনো বিষয়ে দায়িত্ব পালন করবে বলে জানা যায়। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশি দল এর পরিচালনার দায়িত্ব নিজেদের হাতে নিতে পারবে না। এটি আমাদের জন্য বড় দুর্বলতা বটে।
বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ও কারিগরি কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ এগিয়ে চলেছে বটে কিন্তু কেন্দ্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বর্তমানে আমরা পুরোপুরি মাত্রায় বিদেশনির্ভর। এ নির্ভরতা থেকে কবে বের হতে পারব, তা কেউ বলতে পারে না।
এক্ষেত্রে অধ্যাপক ড. বদরূল ইমাম ভারতের উদাহরণ টানেন। তিনি বলেন, ষাটের দশকে ভারতের খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানী হোমি ভাবার হাত ধরে ভারতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কার্যক্রম শুরু হয়। এবং আজ পর্যন্ত সেখানে যত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হয়েছে, তা বানানো ও পরিচালনার দায়িত্বে মূলত ভারতীয়রা রয়েছেন। ১৯৬৯ সালে প্রথম নির্মিত ২০০ মেগাওয়াটের তারাপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ধীরে ধীরে বড় আকারের কেন্দ্র বানানোর অভিজ্ঞতা অর্জন করে ভারত আজ এ ক্ষেত্রে সক্ষম একটি দেশ।
কিন্তু আমরা নিজেদের কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই পুরোপুরি বিদেশনির্ভর হয়ে ২৪০০ মেগাওয়াটের বিরাট আকারের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছি, যার পরিচালনার দায়িত্ব আমরা কবে নিতে পারব, তা জানি না। আমাদের এই শতভাগ পরনির্ভরশীলতার অবশ্যই বড় ঝুঁকি রয়েছে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা বা অন্য যেকোনো বিষয়ে মতানৈক্য হলে বাংলাদেশ সব সময় অপর পক্ষের মত ও মর্জিকে মেনে নেওয়ার চাপে থাকবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫১৫
আপনার মতামত জানানঃ