চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে দেশে রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মোট ৩৮৭টি। এতে নিহত হয়েছেন ৫৮ জন ও আহত হয়েছেন প্রায় ৫ হাজার ৪০০ জন। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ১৫ জন নিহত হয়েছেন।
শুক্রবার মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রকাশিত গত ৯ মাসের মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
দশটি জাতীয় দৈনিক, অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ‘নিজস্ব সূত্র’ থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে এ পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।
আসক জানায়, বছরের প্রথম ৯ মাসে দেশে ৩৮৭ রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ৫৮ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘাতে মারা যান ৪৮ জন। এই ৪৮ জনের মধ্যে ৪৪ জনই নিহত হয়েছেন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘাতে; বাকি চারজনের প্রাণহানি হয়েছে বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষে।
বছরের প্রথম ৯ মাসের রাজনৈতিক সহিংসতার তথ্য বিশ্লেষণ করে আসক জানায়, স্থানীয় নির্বাচনসহ রাজনৈতিক কারণে দেশের ৬৪টি জেলার প্রায় সবকটিতেই সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সহিংসতার সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে কুমিল্লায়। এ জেলায় ২৫টি সহিংসতার ঘটনায় দুজনের মৃত্যুসহ ২৫৬ জন আহত হয়েছেন। চট্টগ্রামে ২৩টি ঘটনায় ছয়জন নিহত এবং ৩০২ জন আহত হয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ, বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ৯ মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু, অপহরণ ও রহস্যজনক নিখোঁজ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে হয়রানি, সীমান্তে নির্যাতন ও হত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে বলে উল্লেখ করেছে সংগঠনটি।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে আসক জানায়, ৯ মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ১৫ জন নিহত হয়েছেন।
তাদের মধ্যে ৯ জন পুলিশের হাতে এবং ৫ জন র্যাব এবং একজন ডিবি পুলিশের হাতে নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে তিনজন, শারীরিক নির্যাতনে সাতজন, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে একজন, অসুস্থ হয়ে তিনজন মারা যান। এছাড়া হেফাজতে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে একটি।
এই সময়ে কারা হেফাজতে মারা গেছেন ৫৪ জন; তাদের মধ্যে কয়েদি ২০ জন, বাকি ৩৪ জন হাজতি।
আসক বলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে চারজনকে এই সময়ে তুলে নেওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে একজন ফেরত এসেছেন এবং একজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। “দুইজন এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বরাবরের মত এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।”
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত নয় মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৭৩৪ নারী। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৪ জনকে, ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন সাতজন এছাড়া ১২৮ জন নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে।
গত নয় মাসে ১৭৯ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি, মামলা এবং পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখিন হয়েছেন।
আসকের সঙ্কলিত তথ্য বলছে, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৩৬৭ জন নারী। এর মধ্যে ২২৮ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে। পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৬৭ জন নারী।
যৌন হয়রানি কেন্দ্রিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন ২০৯ জন নারী ও পুরুষ, যাদের মধ্যে হামলার শিকার হয়েছেন ১৩৬ জন নারী এবং ৭৩ জন পুরুষ। যৌন হয়রানির কারণে সাতজন নারী আত্মহত্যা করেছেন।
অন্যদিকে যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে বখাটেরা ছয়জন পুরুষকে হত্যা করেছে। এছাড়া শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৭২ জন নারী। যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ১৪৮ জন নারী। যৌতুকের জন্য শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ৬৯ জনকে এবং যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৬ জন নারী।
এ সময় মোট ১৯ জন গৃহকর্মী বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যাদের মধ্যে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন মোট ১১ জন নারী। যাদের মধ্যে ৩ জন মারা গেছেন।
গত নয় মাসে ১৭৯ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি, মামলা এবং পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখিন হয়েছেন বলে উঠে এসেছে আসকের প্রতিবেদনে।
এর মধ্যে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে হামলার শিকার হয়েছেন অন্তত ৬৬ জন সংবাদকর্মী। দুর্বৃত্তদের গুলিতে কুমিল্লায় নিহত হয়েছেন একজন সাংবাদিক।
এই সময়ে সীমান্তে বিএসএফের গুলি, নির্যাতন ও ধাওয়ায় নিহত হয়েছেন ১২ বাংলাদেশি নাগরিক। এছাড়া ৭ জন আহত এবং ৮ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন বলে তথ্য দিয়েছ আসক।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে পুলিশ নিজেরাই তদন্ত করে, ফল যা হওয়ার তা-ই হয়, যে পুলিশ মামলাই নিতে চায় না, তার হাতে তদন্তের ভার দিলে এর চেয়ে ভিন্ন কিছু হওয়ার কারণ নেই। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য কোনো স্বাধীন কমিশন গঠনের ইচ্ছা বা আগ্রহ যে সরকারের নেই, তা-ও সহজেই বোধগম্য।
তারা আরও বলেন, পুলিশের কর্মকর্তারা একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি করেছেন, যেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) আইন বাতিল করে দেওয়া হয়। এই দাবি একেবারে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে এমন নয়। তদুপরি, পুলিশ বাহিনীকে যেভাবে রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে, তাতে এই বাহিনীর সদস্যরা যে নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বেই ভাববেন, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই; হেফাজতে মৃত্যু, বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা সেগুলো প্রতিদিন প্রমাণ করে দিচ্ছে।
রাজনৈতিক সহিংসতায় মৃত্যু নিয়ে তারা বলেন, আধিপত্য বিস্তার, প্রভাব বিস্তার ও ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার চেষ্টা ও আদর্শবর্জিত রাজনীতির চর্চার কারণেই অভ্যন্তরীণ সংঘাত বেড়ে যাচ্ছে। নিজ রাজনৈতিক দলের ভেতরে এ প্রতিযোগিতা চলবে। যেহেতু রাজনীতিটা আদর্শবিহীন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জবাবদিহিতা নাই, স্বচ্ছতা নাই। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও এগুলো নাই। এ কারণেই সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৫৩
আপনার মতামত জানানঃ