প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে যুগে যুগে ভ্রমণকারীরা মুগ্ধ হয়েছে। ঐতিহাসিক ও আত্মিক সকল সম্পদেই বাংলাদেশ সমৃদ্ধ। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ স্বল্প আয়তনের দেশ হলেও বিদ্যমান পর্যটক আকর্ষণে যে বৈচিত্র্য তা সহজেই পর্যটকদের আকর্ষণ করতে সক্ষম। তাই যুগ যুগ ধরে দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের কাছে বাংলাদেশ চিরসবুজে ঘেরা এক স্বপ্নের দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু এবং প্রাচীন সভ্যতার একটি কেন্দ্র হিসেবে পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো অনেক সম্পদ রয়েছে এ দেশে। তবে পর্যটক হয়রানির কারণে দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এদিকে বিভিন্ন পর্যটন স্পটে ভ্রমণে গিয়ে দেশের শতকরা ৮৭ ভাগ পর্যটক হয়রানির শিকার হন বলে দাবি করেছে পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলন।
মঙ্গলবার (২৭ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক পর্যটন দিবস উপলক্ষে রাজধানীর মালিবাগে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ‘পর্যটন শিল্পের সম্প্রসারণে অপরিকল্পিত পদক্ষেপ, সরকার ও উদ্যোক্তাদের করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এ দাবি করেন বক্তারা।
সবুজ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান বাপ্পি সরদার বলেন, বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ১১ জেলায় সবুজ আন্দোলনের কর্মীদের মাধ্যমে ডাটা সংগ্রহের চেষ্টা করেছি। এক্ষেত্রে দেখা গেছে শতকরা ৮৭ জন ব্যক্তি হয়রানির শিকার হয়েছে। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করার ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে বিদেশি গাছ রোপণ ও সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রকৃতি তার সৌন্দর্য হারাচ্ছে। বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা প্রশাসনের দ্বারা নিয়মিত হয়রানির শিকার হচ্ছে, যা অচিরেই বন্ধ করতে হবে।
পর্যটন শিল্পের বিকাশে প্রধান সমস্যা হলো নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পর্যটন খাতের মতো গুরুত্ত্বপূর্ণ খাতে নিরাপত্তা খুবই নিম্নমানের। যার কারণে ঘটছে ধর্ষণ, হত্যা, ছিনতাই, মানহানিসহ মৃত্যুর মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। যার কারণে নারীরাও ভ্রমণে নিরাপত্তাবোধ করেন না।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের সব থেকে সম্ভাবনাময় খাত পর্যটন শিল্প। সব থেকে অবহেলিত খাতও পর্যটন শিল্প। একটি সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে পর্যটন খাতের উন্নয়ন করতে পারলে বাংলাদেশের জিডিপিতে ২০ ভাগ পর্যন্ত অবদান রাখতে পারে। পর্যটকদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা ও হোটেল মোটেলের সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করা সম্ভব।
প্রতিবছর পর্যটন খাত আমাদের জাতীয় জিডিপির ১১ শতাংশ যোগান দেয় এবং কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৮০ লাখ মানুষের। করোনাকালীন সময়ে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত প্রতিবছর পর্যটন খাত থেকে আয় করে ১০ হাজার ৭৩০ মিলিয়ন ডলার, মালদ্বীপ ৮০২ মিলিয়ন ডলার, শ্রীলঙ্কা ৩৮৫ মিলিয়ন ডলার, নেপাল ১৯৮ মিলিয়ন ডলার কিন্তু বাংলাদেশ আয় করে মাত্র ৭৬ দশমিক ১৯ মিলিয়ন ডলার।
এ সময় সংগঠনের পক্ষ থেকে বেশ কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়। প্রস্তাবনা গুলো হচ্ছে— প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা যাবে না এবং দেশীয় প্রজাতি গাছের চারা রোপণে বাধ্যবাধকতা রাখা। পর্যটকদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য টুরিস্ট পুলিশের আধুনিকায়ন, অর্থ বরাদ্দ ও লোকবল বৃদ্ধি সহ আরও বেশ কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পর্যটন শিল্পের বিকাশে প্রধান সমস্যা হলো নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পর্যটন খাতের মতো গুরুত্ত্বপূর্ণ খাতে নিরাপত্তা খুবই নিম্নমানের। যার কারণে ঘটছে ধর্ষণ, হত্যা, ছিনতাই, মানহানিসহ মৃত্যুর মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। যার কারণে নারীরাও ভ্রমণে নিরাপত্তাবোধ করেন না।
তারা বলেন, দেশের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্র সুনামগঞ্জের টাঙুয়ার হাওর কেন্দ্রিক। এখানে নেই কোনো ট্যুরিস্ট পুলিশ। হাওরে যেসব ট্রলারে করে পর্যটকরা ভ্রমণ করেন সেসব ট্রলারও অসাধু সিন্ডিকেট গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করে। শুধু সুনামগঞ্জ নয়, দেশের বেশিরভাগ পর্যটন এলাকা এধরণের অসাধু সিন্ডিকেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
তারা বলেন, পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে অহরহ ঘটে চলছে চুরি-ছিনতাই, হত্যাসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড। তাছাড়াও বছর দুয়েক আগে অস্ট্রেলিয়ার একজন নারী পর্যটক যৌন নিপীড়নে শিকার হয়েছে যা আদৌ কাম্য নয়। সম্প্রতি একজন নারী অপহরণের পর দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনা সারাদেশে আলোচিত বিষয়।
এ ঘটনা পর্যটন শিল্পের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ হয়েছে এবং নিরাপত্তার শংকা বোধ করে বহু পর্যটক। পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ট্যুরিস্ট পুলিশের সংখ্যাও কম। উপরোক্ত পর্যালোচনা থেকে বোঝা যায় পর্যটন শিল্প সমৃদ্ধ হলেও নিরাপত্তা কতটুকু! পর্যটন শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে হলে আমাদেরকে পর্যটকদের প্রতি সংবেদনশীল হওয়া দরকার। তাছাড়াও পর্যটকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা থাকা দরকার এই বিষয়গুলো নিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হবে।
বৈশ্বিক মহামারি করোনা বিপর্যয় কাটিয়ে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর সর্বশেষ গত ১৯ আগস্ট থেকে পাহাড়ের পর্যটন কেন্দ্রগুলো খুলে দিয়েছে সরকার। এমন সিদ্ধান্তে এ খাতে কাজ করে দেশের প্রায় ৪৫ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে আশার আলো সঞ্চয় হয়েছে। তবে শঙ্কা কাটেনি এখনো। এ খাতে শ্রমিকদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চয়তা অভাব রয়েছে।
এমন অবস্থায় পর্যটন হাতের ক্ষত দূর করতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত প্রণোদনা, স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় ও এ খাতের কর্মীদের প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা এমনটাই বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০১৩
আপনার মতামত জানানঃ