২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনে ধরা পড়ে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। এরপর থেকে সারা পৃথিবীতে এই ভাইরাসের প্রভাব পড়তে থাকে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকে সব ধরনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পর্যটন খাত, যার বিরূপ প্রভাব এখনও বিদ্যমান।
জাতিসংঘের প্রতিবেদন বলছে, এ বছর মোট ক্ষতি দুই ট্রিলিয়ন ডলারও হতে পারে। করোনা সংকটের কারণে ২০২০ সালে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল পর্যটন শিল্পের। ভ্যাকসিন চলে আসায় এ বছর পর্যটন আবার চাঙা হয়ে উঠবে এমন আশা করা হলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না। খবর এএফপি, রয়টার্স
সোমবার (ইউএনডাব্লিউটিও) এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছর সারা বিশ্বে পর্যটন শিল্পের ক্ষতি দু্ই ট্রিলিয়ন ডলার (১.৭৭ ট্রিলিয়ন ইউরো) হতে পারে। অবশ্য ২০২০ সালেও দুই ট্রিলিয়ন ডলারেরই ক্ষতি হয়েছিল। কিন্তু জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে গত বছরের তুলনায় আয় শতকরা ৫৮ ভাগ বৃদ্ধি পাওয়ায় বছর শেষে সার্বিক চিত্রে বড় পরিবর্তনের আশা জাগে। কিন্তু বিশ্বের সব দেশে একই হারে করোনার টিকা না দেয়ায় এবং সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট বিভিন্ন দেশে আতঙ্ক ছড়ানোয় পর্যটন খাতে ক্ষতি বৃদ্ধির আশঙ্কা আবার বেড়েছে।
ইউএনডাব্লিউটিও-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে ইউরোপ এবং আমেরিকার পর্যটন শিল্পে সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বিপরীতে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি ছিল এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায়। ২০১৯ সালের তুলনায় এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের দেশগুলোর পর্যটনের সার্বিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৯৫ ভাগ। এ পরিস্থিতির মূল কারণ কঠোর স্বাস্থ্যবিধি ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা।
অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, চীনসহ কিছু দেশ ‘জিরো কোভিড’ নীতিতে চলায় সেসব দেশে ২০২১ সালেও পর্যটক যেতে পারেনি। তবে ২০২১ সালে ক্রোয়েশিয়া, মেক্সিকো এবং তুরস্কের পর্যটন-নীতি ছিল ভিন্ন। চলতি বছর ধীরে ধীরে পর্যটকদের স্বাগত জানাতে শুরু করায় এসব দেশের পর্যটন শিল্পে চাঙাভাব ফিরে আসে। তবে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট আতঙ্ক ছড়াতে শুরু করায় আবার দেশে দেশে করোনাবিধির কঠোর প্রয়োগ শুরু হয়েছে। সব দেশে সমান হারে টিকা না দেয়ায় করোনা পরিস্থিতির আবার অবনতি হচ্ছে। বছরের বাকি সময়ে এর প্রভাব পর্যটন শিল্পে পড়বে বলে ইউএনডাব্লিউটিও-র আশঙ্কা।
এ বছর মোট ক্ষতি দুই ট্রিলিয়ন ডলারও হতে পারে। করোনা সংকটের কারণে ২০২০ সালে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল পর্যটন শিল্পের। ভ্যাকসিন চলে আসায় এ বছর পর্যটন আবার চাঙা হয়ে উঠবে এমন আশা করা হলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না।
করোনার প্রভাবে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প-সংশ্নিষ্ট সব সেবা ২০২০ সালের মার্চ মাসের শেষ দিক থেকে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিল। তারপর কিছুদিন সীমিত পরিসরে খুলে দেওয়া হলেও ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে তা আবারও বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাতে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প পড়ে সীমাহীন ক্ষতির মুখে। একদিকে পর্যটনশিল্প সম্পর্কিত সবাই যেমন হারিয়েছে তাদের মুনাফা, পাশাপাশি ব্যাপক কর্মসংস্থানহানি হয়েছে।
পর্যটনশিল্পের ক্ষতিগ্রস্ত সেক্টরের মধ্যে হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, ট্যুর অপারেটর, ট্রাভেল এজেন্সি, এয়ারলাইন্স ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সংক্রমণ রোধে ঈদের সময়ও বন্ধ রাখা হয় সকল পর্যটন এলাকা। করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর গত ১৯ আগস্ট থেকে খুলেছে দেশের পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো।
করোনায় দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকার পর মানুষ প্রাণ খুলে একটু নিঃশ্বাস নিতে ছুটছে সাগর পাহাড় অথবা প্রকৃতির কাছে। ফলে পর্যটন কেন্দ্রগুলো ভ্রমণপিপাসুদের পদচারণায় আবার মুখর হয়ে উঠেলেও তেমন আশানুরূপ পর্যটক পাচ্ছেন না হোটেল মালিকরা।
এক বছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) লোকসান হয়েছে প্রায় সাড়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা। ট্যুরিজম খাতের অন্যতম সংগঠন ট্যুর অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) বলছে, করোনা শুরুর পর গেলো দেড় বছরে শুধু ট্যুর অপারেটরদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টেস বাংলাদেশ (অ্যাটাব) বলছে একই সময়ে তারা প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। আর অ্যাভিয়েশন খাত সংশ্লিষ্টদের সংগঠন অ্যাভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ চলতি বছর তাদের ক্ষয়ক্ষতির কোনো হিসাব দিতে না পারলেও তাদের ধারণা সঠিক হিসাব এলে ক্ষতির পরিমাণ হাজার হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
পাটা বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের মতে, ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের পর্যটন খাতের সব ক্ষেত্রে প্রায় ৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। একই সঙ্গে প্রায় তিন লাখ ১০ হাজার মানুষ তাদের কর্মসংস্থান হারিয়েছে।
তবে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মতে এই চিত্র আরও ভয়াবহ। তাদের তথ্য মতে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বাংলাদেশের পর্যটন খাতে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে এবং ঝুঁকির মুখে পড়েছে প্রায় ৪০ লাখ জনবল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্যটনশিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি সম্ভাবনাময় অধ্যায়ের নাম। এ শিল্প টিকিয়ে রাখা ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সরকার ও আমাদের দায়িত্ব। এই উন্নত প্রযুক্তির যুগে এসে করোনাভাইরাসকেও মানুষ জয় করে টিকে থাকবে। পৃথিবীব্যাপী পর্যটনক্ষেত্র চালু করার জন্য বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করছে যা আমাদের জন্য অনুকরণীয়। পাশাপাশি শুধু সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলে ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা যথাসম্ভব মেনে চললে করোনাভাইরাস আমরা জয় করতে পারব। এমতাবস্থায় আমরা আমাদের পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসা পুনরায় চালু করতে পারি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০০
আপনার মতামত জানানঃ