সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ ছাত্রাবাসে এক নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার দ্বিতীয় বার্ষিকীতেও শুরু হয়নি এ ঘটনায় হওয়া মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ।
২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর কলেজের একটি ছাত্রাবাসে স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে আসা নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
ঘটনার দুই বছর পেরিয়ে গেলেও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু না হওয়ায় বিচারে দীর্ঘসূত্রিতার আশঙ্কা করছে বাদীপক্ষ। তাদের অভিযোগ, আসামিরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত তারা।
মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিকালে দক্ষিণ সুরমার এক যুবক তার নববিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে ঘুরতে এসেছিলেন। সন্ধ্যার পর কলেজের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান করছিলেন তারা। এ সময় কয়েকজন যুবক তাদের ঘিরে ধরে। এক পর্যায়ে তাদের জোরপূর্বক জিম্মি করে গাড়িতে তুলে কলেজের ছাত্রাবাসের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বামীর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে স্ত্রীকে ধর্ষণ করে তারা। পরে জানা যায় ওই যুবকরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।
ওই ঘটনায় গত বছরের জানুয়ারিতে ধর্ষণ মামলার ও চলতি বছরের মে মাসে চাঁদাবাজির মামলার অভিযোগ গঠন করা হলেও এখন পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুই হয়নি। এদিকে সাক্ষ্য শুরু না করায় রাষ্ট্রপক্ষকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। তবে মামলার বাদী দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেছেন।
আদালত সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের আট নেতাকর্মীকে অভিযুক্ত করে মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা ও মহানগর পুলিশের শাহপরান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য। গণধর্ষণের ঘটনায় সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার চান্দাইপাড়ার তাহিদ মিয়ার ছেলে সাইফুর রহমান (২৮), হবিগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার বাগুনীপাড়ার শাহ জাহাঙ্গীর মিয়ার ছেলে শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রনি (২৫), সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার উমেদনগরের মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে তারেকুল ইসলাম তারেক (২৮), জকিগঞ্জের আটগ্রামের মৃত অমলেন্দু লস্কর ওরফে কানু লস্করের ছেলে অর্জুন লস্কর (২৬), দিরাই উপজেলার বড়নগদীপুরের দেলোয়ার হোসেনের ছেলে রবিউল ইসলাম (২৫), কানাইঘাট উপজেলার লামা দলইকান্দির (গাছবাড়ী) সালিক আহমদের ছেলে মাহফুজুর রহমান মাসুম (২৫), সিলেট নগরীর গোলাপবাগ আবাসিক এলাকার (বাসা নম্বর-৭৬) মৃত সোনা মিয়ার ছেলে আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল (২৬) ও বিয়ানীবাজার উপজেলার নটেশ্বর গ্রামের মৃত ফয়জুল ইসলামের ছেলে মিজবাউল ইসলাম রাজনকে (২৭) অভিযুক্ত করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়।
মামলায় ৫২ জনকে সাক্ষী রাখা হয়। ঘটনার মাত্র দুই মাস ৮ দিন পর ১৭ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রটি আদালতে জমা দেওয়া হয়। এতে আসামি রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান ওরফে মাসুমকে ধর্ষণে সহায়তা করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়। আট আসামিই বর্তমানে কারাগারে আছেন। ঘটনার পরে গ্রেফতার ৮ জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সিলেট ওসমানী মেডিক্যালের ওসিসি’র মাধ্যমে ডিএনএ সংগ্রহ করে ঢাকায় সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠায় পুলিশ। নমুনা সংগ্রহের প্রায় দুই মাস পর ডিএনএ রিপোর্ট এসে পৌঁছে। ডিএনএ রিপোর্টে ছাত্রলীগ কর্মী সাইফুর রহমান, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর ও মাহবুবুর রহমান রনির ডিএনএ ‘ম্যাচিং’ পাওয়া যায়।
এছাড়া ছাত্রাবাস থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় সাইফুর রহমান ও শাহ মাহবুবুর রহমান রনিকে আসামি করে অস্ত্র আইনে আরেকটি অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। ঘটনার এক মাস ২৭ দিন পর অস্ত্র মামলার অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এদিকে, গ্রেফতারের পর আট আসামির সবাই আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।
আসামিরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত তারা।
আসামিদের মধ্যে সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর, মিজবাহুল ইসলাম রাজন ও আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল ১৯ বছর বয়সী ওই নারীকে সরাসরি ধর্ষণ করে। রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান মাসুম ধর্ষণে সহযোগিতা করে। আট আসামির সবাই ছাত্রলীগের টিলাগড় গ্রুপের সক্রিয় কর্মী ছিল।
যে কারণে সাক্ষ্যগ্রহণ আটকে আছে
সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার পরদিন ওই নারীর স্বামী বাদী হয়ে সিলেটের শাহপরান থানায় মামলা করেন। এ ছাড়া ওই রাতে ছাত্রাবাস থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় চাঁদাবাজি ও অস্ত্র আইনে আরেকটি মামলা করে পুলিশ।
২০২০ সালের ২২ নভেম্বর অস্ত্র ও চাঁদাবাজি মামলার অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। এরপর ধর্ষণ মামলায় ওই বছরের ৩ ডিসেম্বর ৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা হয়।
২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মোহিতুল হক চৌধুরী মামলার অভিযোগ গঠন করে বিচারকাজ শুরু করেন। আর চলতি বছরের ১১ মে একই আদালতে অস্ত্র ও চাঁদাবাজির মামলার অভিযোগ গঠন করে আদালত।
ধর্ষণ মামলার অভিযোগ গঠনের পর ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ঠিক করেছিলেন আদালত, তবে ওই বছরের ২৪ জানুয়ারি আদালতে দুটি মামলার বিচার কার্যক্রম একসঙ্গে শুরুর আবেদন করেন বাদীপক্ষ। শুনানি শেষে বিচারক আবেদনটি খারিজ করে দেন।
এরপর বাদীপক্ষ এই আবেদন জানিয়ে উচ্চ আদালতে ফৌজদারি বিবিধ মামলা করে। গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের ভার্চুয়াল বেঞ্চ মামলা দুটির বিচার কার্যক্রম একসঙ্গে একই আদালতে সম্পন্নের আদেশ দেয়। এরপর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বদলে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলা দুটির কার্যক্রম চালানোর আবেদন করে বাদীপক্ষ।
বাদীর আইনজীবী সূত্রে জানা যায়, অভিযোগ গঠনের দীর্ঘদিন পরও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু না হওয়ায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলা দুটির কার্যক্রম চালানোর জন্য গত ১ আগস্ট বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চে বাদী একটি রিট করেন। ১৬ আগস্ট রিটের শুনানি শেষে দুই মামলার কার্যক্রম দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বদলির প্রক্রিয়া গ্রহণে কেন নির্দেশনা দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের এই আদেশের কপি এখনও হাতে আসেনি বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্র ও বাদীপক্ষের আইনজীবীরা।
এর আগে ২৭ জুলাই আসামি রবিউল ইসলামের জামিন শুনানিতে মামলার বিচার বিলম্বিত হওয়ায় উষ্মা প্রকাশ করেন বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার কাজলের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
আদালত সূত্রে জানা জানা যায়, মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা হয় না মর্মে রাষ্ট্রপক্ষকে গত ২১ আগস্ট কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহিতুল হক। ১৬ অক্টোবর এ বিষয়ে শুনানির পরবর্তী তারিখ ঠিক করেন বিচারক।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রাশিদা সাঈদা খানম বলেন, ‘আদালতের কারণ দর্শানোর নোটিশের বিষয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়া হয়েছে।’
আর বাদীপক্ষের আইনজীবী শহীদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘মামলার দুই বছর পেরিয়েছে। অভিযোগ গঠনেরও অনেক দিন চলে গেছে। এখনও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু না হওয়ায় বিচার পাওয়া নিয়েই শঙ্কা দেখা দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘একই ঘটনায় পুলিশের দুটি অভিযোগপত্র দেয়ায় বাদীপক্ষের সন্দেহ সৃষ্টি হয়। এতে ন্যায়বিচার ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি সাক্ষীদের জন্যও বিষয়টি বিড়ম্বনার। কারণ চাঞ্চল্যকর এ মামলার সাক্ষীরা দুই আদালতে দুই দিন আসবেন কি না, এ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
‘কারণ ধর্ষণকারীরা সবাই নানাভাবে প্রভাবশালী। এ জন্য বাদীপক্ষ উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন। উচ্চ আদালত ইতোমধ্যে সংক্ষিপ্ত আদেশও দিয়েছেন। পূর্ণাঙ্গ আদেশের কপি পাওয়ার পর মামলার ভবিষ্যৎ করণীয় ঠিক করা হবে।’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাধারণত ধর্ষণের পর প্রভাশালীরা সালিশসহ নানা বাহানায় সময় পার করে৷ তারপর থানায় গেলে থানা নানাভাবে মামলা নিতে দেরি করে৷ ফলে ধর্ষণ প্রমাণ কঠিন হয়ে পড়ে৷
কুমিল্লার তনু, দিনাজপুরের পূজার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে৷ তনুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে৷ তনু ধর্ষণ এবং হত্যার ঘটনা ঘটেছে সেনানিবাসের মধ্যে৷ সেখানেও ধর্ষকরা ঢাকার ঘটনার মতো প্রভাবশালী৷
বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রভাবশালীরা কয়েকভাবে ধর্ষণ মামলাকে দুর্বল করার চেষ্টা করে৷ তারা প্রথমে চেষ্টা করে মেডিক্যাল টেস্টকে দুর্বল করতে৷ বাদি এবং সাক্ষী উভয়কে চাপ ও হুমকি দিয়ে সমঝোতা করাতে এবং আলামত নষ্ট করতে৷ আর এই কাজে প্রভাবশালীরা রাজনৈতিক প্রভাব, অর্থ এবং পুলিশকে কাজে লাগায়৷
তারা বলেন, পুলিশ প্রভাবশালীদের হয়ে ধর্ষণের শিকার যারা হন, তাদের ‘চরিত্র হরণ’ করে৷ একই সঙ্গে মেডিক্যাল টেস্টের জন্য পাঠাতে দেরি করে, যাতে ঘটনা প্রমাণ করা না যায়৷
তারা মনে করেন, আদালতে ধর্ষণ মামলার বিচার প্রক্রিয়াও ত্রুটিপূর্ণ৷ ধর্ষণকে যেভাবে আদালতে প্রমাণ করতে হয়, সাক্ষ্য আইন মেনে তা অনেক জটিল এবং অবমাননাকর৷ ফলে অনেক ভিকটিম মামলা করলেও আর শেষ পর্যন্ত আদালতে যান না৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৪২
আপনার মতামত জানানঃ