নিজেদের মধ্যে আঁতাত করে ব্যাংকের পরিচালকরা মিলেমিশে একে অন্যের ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত জুন শেষে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিতরণ করা ঋণের স্থিতি ছিল ১৩ কোটি ৯৮ হাজার ৫১২ কোটি টাকা। এসব ঋণের মধ্যে এক ব্যাংকের পরিচালকদের অন্য ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৯ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৪২ শতাংশ। তিন মাস আগে পরিচালকদের এ ধরনের ঋণের স্থিতি ছিল আরও বেশি, প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা বা ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
শুধু পরিচালকই নন, ব্যাংক থেকে তাদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবও ক্ষমতার জোরে নিয়মবহির্ভূত ঋণ নিয়েছেন। এসব ঋণের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খেলাপি হলেও বছরের পর বছর তা ‘নিয়মিত’ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। আবার ঋণ ফেরত না দিয়ে পরিচালকদের মধ্যে অনৈতিকভাবে সুদ মওকুফ করে নেওয়ার প্রবণতাও বাড়ছে।
সর্বশেষ তিন মাসে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি সুদ মওকুফ করেছে, যার সিংহভাগই পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বলে জানা গেছে।
চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন- এই তিন মাসে বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের বিতরণ করা ঋণে সুদ মওকুফ করেছে ২ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। যা আগের প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ছিল মাত্র ১৯১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো আগের প্রান্তিকের তুলনায় ২ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা বেশি সুদ মওকুফ করেছে, যা প্রায় ১২ গুণ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে সুদ মওকুফ পাওয়া গ্রাহকদের নাম উল্লেখ করা হয়নি, তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সুদ মওকুফের সিংহভাগ সুবিধা নিয়েছেন ব্যাংকের পরিচালকরা। কিছু ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যাংকগুলো এখন অন্যান্য ব্যাংকের পরিচালকদের সঙ্গে মিলেমিশে যোগসাজশের মাধ্যমেও সুদ মওকুফ করছে।
ব্যাংকের পরিচালক, পরিবারের সদস্য বা তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সুদ মওকুফে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদনের যে বাধ্যবাধকতা দেওয়া ছিল, গত ২৪ মে তা তুলে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এই শর্ত শিথিলের পরই ব্যাংক ও পরিচালকরা কৌশলে নিজেদের ঋণের সুদ মওকুফ করে নিচ্ছেন। যদিও এই শর্ত শিথিলের আগেও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি সাপেক্ষে দেশের শীর্ষ দুই ব্যবসায়ী গ্রুপ একে অপরের ব্যাংক থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার সুদ মওকুফ সুবিধা নেয়
অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা অনাদায়ী ঋণের আসল টাকা আদায় করতে গিয়ে সুদ মওকুফের কৌশল নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। তবে কিছু ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যাংকগুলো এখন অন্যান্য ব্যাংকের পরিচালকদের সঙ্গে মিলে যোগসাজশের মাধ্যমেও সুদ মওকুফ করছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় থাকাকালীন ২০১৯ সালে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদ মওকুফ করেছে ২ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। ২০২০ সালে করেছে ১ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা এবং বিদায়ী ২০২১ সালে ব্যাংকগুলো ১ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা ঋণের সুদ মওকুফ করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আমানতকারীদের জমা রাখা টাকা ফেরত দিতে পারে না, অথচ সেই ব্যাংক সুদ মওকুফ করেছে। ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ২৩ হাজার ১৬৬ কোটি ১২ লাখ টাকার সুদ মওকুফ করেছে ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণে, যেমন- ঋণগ্রহীতার মৃত্যু, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি, মড়ক, নদীভাঙন, দুর্দশাজনিত কারণে বা বন্ধ প্রকল্প ইত্যাদি কারণে ব্যাংক কর্তৃক ঋণের সুদের সম্পূর্ণ অংশ বা অংশবিশেষ মওকুফ সুবিধা প্রদানের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি লক্ষ করা যাচ্ছে, বর্ণিত বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে ব্যাংক কর্তৃক বিভিন্ন গ্রাহকের অনুকূলে প্রায়শই সুদ মওকুফ সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর এই বছরের জুন মাস শেষে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে ৫৫ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা খেলাপি রয়ে গেছে, যা মোট ঋণের ২১.৯৩ শতাংশ। এদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬২ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা।
চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন- এই তিন মাসে বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের বিতরণ করা ঋণে সুদ মওকুফ করেছে ২ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। যা আগের প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ছিল মাত্র ১৯১ কোটি টাকা।
কয়েক বছর আগে গ্রাহকের সুদ মওকুফ করতো কেবল সরকারি ব্যাংকগুলো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ঠিক উল্টো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় কাছাকাছি থাকলেও সুদ মওকুফে এগিয়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলো।
চলতি বছরে (এপ্রিল-জুন) সরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে ৮২২ কোটি টাকা, এরমধ্যে সুদ মওকুফ হয়েছে ১৯ কোটি টাকা। এছাড়া, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে ২ হাজার ২১১ কোটি টাকা, অথচ তারা সুদ মওকুফ করেছে ২ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের বেশিরভাগই দেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। কয়েক কোটি টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যাংকের পরিচালক হয়েছিলেন এমন অনেকেই এখন শত শত কোটি টাকার মালিক। আর তা সম্ভব হয়েছে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণ বের করে নেওয়ার কারণেই। প্রভাব বিস্তার করে নেওয়া এসব ঋণ তারা ঠিকমতো ফেরতও দিচ্ছেন না। পুনঃতফসিল ওপুনর্গঠন করে বছরের পর বছর নিয়মিত রাখতে বাধ্য করেন।
গত কয়েক বছরে ব্যাংক পরিচালকদের হস্তক্ষেপে বেশ কিছু জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে কিছু পরিচালকের স্বার্থসংশ্লিষ্টতায় সোনালী ব্যাংকে ঘটেছে হলমার্ক কেলেঙ্কারি। বেসিক ব্যাংকে হয়েছে নজিরবিহীন লুটপাট। কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালকদের সংশ্লিষ্টতায় ঘটেছে বিসমিল্লাহ গ্রুপের জালিয়াতি। পরিচালকদের হস্তক্ষেপে সরকারি ব্যাংকের সিএসআরের টাকা নিয়ে নয়ছয় হয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যাংকিং খাতে সংঘটিত ৯০ শতাংশ অনিয়ম-অপরাধে ব্যাংকের নিজস্ব লোকজন জড়িত থাকেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক ব্যবসার মূল উৎস জনগণের আমানত। সাধারণ মানুষ থেকে আমানত সংগ্রহ করে তা ঋণ হিসেবে বিতরণ করা হয়। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো সুদ অথবা মুনাফা নামে আয় করে। যে কোনো ব্যাংকের মোট আমানতের প্রায় ৯০ শতাংশ আসে সাধারণ গ্রাহকের কাছ থেকে। সে অর্থে ব্যাংকের প্রকৃত মালিক আমানতকারীরা।
তাদের মতে, যদিও বাস্তবে তার কোনো স্বীকৃতি নেই। উলটো ১০ শতাংশ শেয়ারধারীই ছড়ি ঘুরান সব সময়। ক্ষেত্রবিশেষ আমানতকারীরা তাদের জমানো টাকাও ফেরত পান না। সুদ মওকুফ সুবিধার কারণে ব্যাংকের নিট আয় এবং আমানতকারীদের সুদ আয় কমে যায়। এতে ডিভিডেন্ড (লভ্যাংশ) কম হয়, পাশাপাশি সরকারও রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। তবে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা সুদ মওকুফের সুবিধা খুব বেশি পান না। এখানেও প্রভাবশালীদের হাত। এ সুবিধার বেশিরভাগই ভোগ করেন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা। এতে আমানতকারীরা লোকসানে পড়েন।
বিশেষজ্ঞদের আরও অভিমত, সব সময় বড় ঋণখেলাপিরা বেশি সুদ মওকুফ-সুবিধা পান। ক্ষুদ্র ও মাঝারি গ্রাহকরা এ সুবিধা থেকে অনেক দূরে থাকেন। কারণ তারা প্রভাব বিস্তার করতে পারেন না। এ প্রক্রিয়ার একটি কুফল হচ্ছে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। তাই ঋণের সুদ মওকুফের একটি নীতিমালা থাকা জরুরি। এতে বোঝা যাবে, কে এই সুবিধা পাওয়ার যোগ্য আর কে যোগ্য নন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১০
আপনার মতামত জানানঃ