বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার দেশ চীন। সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ে মোট বাণিজ্যের প্রায় ১৪ শতাংশই হয় চীনের সঙ্গে। যদিও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য নিয়ে প্রকাশিত দুই দেশের সরকারি পরিসংখ্যানে এখন বড় ধরনের পার্থক্য দেখা যাচ্ছে।
২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসের বাণিজ্য পরিসংখ্যানেও দুই দেশের তথ্যে গরমিল দেখা গিয়েছে ৫৬৮ কোটি ডলারের বেশি।
ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্র গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন, দেশে চীন থেকে পণ্য আমদানির জন্য খোলা এলসির মোট পরিমাণ কাস্টমসের পরিসংখ্যানে উল্লেখিত অংকের চেয়ে বেশ খানিকটা বেশি। সে হিসেবে ভবিষ্যতেও চীন থেকে পণ্য আমদানি-সংক্রান্ত তথ্যে গরমিল অব্যাহত থাকার বড় সম্ভাবনা রয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য থেকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সংকলন করা পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছর বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য হয়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৫৬২ কোটি টাকার বেশি। ২০২১ সালের গড় বিনিময় হার ৮৫ টাকা ৭ পয়সা ধরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৯৪৬ কোটি ১১ লাখ ডলারের কিছু বেশিতে।
অন্যদিকে জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব কাস্টমস অব দ্য পিপলস রিপাবলিক অব চায়নার (জিএসিপিআরসি) পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, এ সময় দুই দেশের মধ্যে সংঘটিত বাণিজ্যের অর্থমূল্য ছিল ২ হাজার ৫১৪ কোটি ১৩ লাখ ডলারের কিছু বেশি। সে হিসেবে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের তথ্যে দুই দেশের সরকারি কর্তৃপক্ষের পরিসংখ্যানগত পার্থক্য দাঁড়ায় ৫৬৮ কোটি ২ লাখ ডলারে।
বড় ধরনের গরমিল দেখা যাচ্ছে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসের বাণিজ্য পরিসংখ্যানেও। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ সময় বাংলাদেশের পণ্য আমদানির অর্থমূল্য ছিল ৯৯৬ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। একই সময়ের মধ্যে চীনে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া পণ্যের অর্থমূল্য ৩২ কোটি ৬০ লাখ ৮৫ হাজার ৬২০ ডলার ছিল বলে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবির) তথ্যে উঠে এসেছে।
এ হিসেবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হয়েছে ১ হাজার ২৯ কোটি ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৬২০ ডলারের।
আবার চীনা শুল্ক কর্তৃপক্ষ জিএসিপিআরসির পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্য হয়েছে ১ হাজার ৪৩০ কোটি ২৪ লাখ ৯৭ হাজার ১৩২ ডলারের। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইপিবির তথ্যের সঙ্গে চীনা শুল্ক কর্তৃপক্ষের বাণিজ্য পরিসংখ্যানে পার্থক্য ৪০১ কোটি ২০ লাখ ১১ হাজার ৫১২ ডলারের।
বাণিজ্য পরিসংখ্যানে এ বিপুল পরিমাণ পার্থক্যের বিষয়টি এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন আলোচনায় জানানো হয়েছে বলে দাবি করছেন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য-সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশীরা। এ ধরনের তথ্যগত পার্থক্য বাংলাদেশের জন্য সুখকর নয় উল্লেখ করে তাদের অভিযোগ, এর কারণ অনুসন্ধান বা পার্থক্য দূর করে সঠিক পরিসংখ্যান প্রকাশে কোনো তৎপরতা এখনো দেখা যায়নি।
এ পার্থক্যের কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশে আমদানি পণ্যের শুল্কায়ন হচ্ছে এলসি মূল্যের ওপর। শুল্ক ফাঁকির উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ীদের অনেকেই এখন আন্ডার ইনভয়েসিং বা আমদানি মূল্য কম দেখানোর কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিংয়ের (আমদানি মূল্য প্রকৃতের চেয়ে বেশি দেখানোর কৌশল) মাধ্যমে চীন হয়ে তৃতীয় কোনো দেশে অর্থ পাচারের ঘটনাও ঘটছে।
মূলত এ দাম বাড়িয়ে-কমিয়ে দেখানোর প্রবণতার কারণেই দুই দেশের বাণিজ্য পরিসংখ্যানে বড় ধরনের ব্যবধান দেখা যাচ্ছে।
চীন থেকে বিপুল পরিমাণে যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আসে বাংলাদেশে। এসব পণ্যে দাম বাড়িয়ে-কমিয়ে দেখানোর বিষয়ে সরকারের প্রতিনিধিরা জানান, আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কায়ন হয় ন্যূনতম আমদানি মূল্যের ওপর। এ সুযোগে দাম কম দেখিয়ে শুল্কও কম দেয়া যায়। এক্ষেত্রে চীনা রপ্তানিকারক ও বাংলাদেশের আমদানিকারক দুই পক্ষেরই যোগসাজশের বিষয় আছে।
চীন-সংশ্লিষ্টরা চাচ্ছেন রপ্তানি যত বেশি করে দেখানো যায়। কারণ সেখানে রপ্তানি যত বেশি, তত বেশি ছাড়ও পাচ্ছেন তারা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, পার্থক্যের কারণ হিসেবে দাম বাড়িয়ে-কমিয়ে দেখানোর বিষয়টির সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। বিষয়টি আরো অনেক গবেষণার দাবি রাখে। সঠিক বিচার বিশ্লেষণ করলে প্রকৃত চিত্র বোঝা যাবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯০০
আপনার মতামত জানানঃ