নিখোঁজের ২৯ দিন পর ফরিদপুরের বোয়ালমারী থেকে উদ্ধার খুলনার রহিমা বেগম পুলিশের কোনো প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না। গ্রেপ্তারের পর থেকে তিনি ‘নির্বাক’ রয়েছেন বলে জানিয়েছেন পুলিশ। গতকাল শনিবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে রহিমা বেগমকে দৌলতপুর থানায় নিয়ে আসা হয়। বর্তমানে তাকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখা হয়েছে।
গত ২৭ আগস্ট রাত ১০টার দিকে খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়া এলাকার বাসার উঠানের নলকূপে পানি আনতে যান রহিমা বেগম। এর পর থেকেই নিখোঁজ ছিলেন তিনি। পরদিন তার মেয়ে আদুরী আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে থানায় অপহরণ মামলা করেন। এ মামলায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
মায়ের সন্ধান চেয়ে ঢাকায় মানববন্ধনের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে দৌড়ঝাঁপ করে আসছিলেন সন্তানেরা। এমন পরিস্থিতিতে গতকাল রাতে তাকে ফরিদপুরের বোয়ালমারী থেকে উদ্ধার করা হয়।
নির্বাক ভুক্তভোগী
রহিমাকে উদ্ধারের বিষয়ে শনিবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে খুলনা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে প্রেস ব্রিফিং করা হয়। নগরের দৌলতপুর থানায় ব্রিফিংয়ে মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) মোল্লা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তারা জানতে পারেন যে রহিমা বেগম ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামের কুদ্দুস মোল্লার বাড়িতে রয়েছেন। আরও খোঁজ নিয়ে তারা বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হন।
এরপর দৌলতপুর জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার আবদুর রহমান ও দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল রাত পৌনে ১১টার দিকে ওই বাড়িতে পৌঁছায়। পুলিশ সেখানে গিয়ে দেখতে পায়, রহিমা বেগম ওই বাড়িতে বসে দুজন নারীর সঙ্গে গল্প করছেন। তবে বাড়ির মালিক কুদ্দুস বাড়িতে ছিলেন না।
পুলিশ সেখানে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও রহিমা বেগম কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি বলে জানান জাহাঙ্গীর হোসেন। তবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কুদ্দুসের ছেলে আলামিন, কুদ্দুসের স্ত্রী ও ভাইয়ের স্ত্রীকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
রহিমা বেগমের আশ্রয় নেওয়া বাড়ির মালিক কুদ্দুস বেশ কয়েক বছর আগে খুলনার সোনালী জুট মিলে চাকরি করতেন। তখন রহিমা বেগমের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। পরে তিনি বোয়ালমারীতের চলে যান। বেশ আগে রহিমা বেগমের এক ছেলে একবার কুদ্দুসের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল।
মোল্লা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে ওই বাড়ির লোকজন পুলিশকে জানিয়েছেন, প্রথমে রহিমা বেগমকে তারা চিনতে পারেননি। পরে চিনতে পারলে সাবেক বাড়িওয়ালা হিসেবে তারা সেবাযত্ন করেছেন। রহিমা তাদের জানিয়েছেন, তিনি বেশ কয়েক দিন চট্টগ্রাম ও গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে ছিলেন। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর বোয়ালমারীতে কুদ্দুসের বাড়িতে যান। তখন তার একটি ব্যাগে দুই প্যাকেট বিস্কুট, কিছু কাগজপত্র ও পরনের কিছু কাপড়চোপড় ছিল।
উপপুলিশ কমিশনার জানান, ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তারা রহিমা বেগমকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। রহিমা বেগম কোনো মুঠোফোন ব্যবহার করেননি। সে কারণে ট্র্যাকিং করা সম্ভব হচ্ছিল না। রহিমা অপহরণ মামলাটির তদন্ত দৌলতপুর থানা-পুলিশের কাছ থেকে পিবিআইতে গেছে। তারপরও খুলনা মহানগর পুলিশ মামলাটির ছায়া তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছিল। পিবিআই তদন্ত করে পুরো রহস্য উন্মোচন করবে।
রহিমা আসলেই অপহরণ হয়েছিলেন নাকি স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে ছিলেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে উপপুলিশ কমিশনার বলেন, উনি কোনো জবাবই দিচ্ছেন না। খাবারদাবারও খেতে চাইছেন না। তবে ইশারা–ইঙ্গিতে কথা বলছেন। জবাব না দিলে এখনই তো কিছু বলা যাচ্ছে না। মামলাটি যেহেতু পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) তদন্ত করছে, তারাই বিস্তারিত উদঘাটন করবে।
মোল্লা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, রহিমা বেগম যেহেতু অপহরণ মামলার ভিকটিম, সে জন্য আপাতত তাকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারেই রাখা হচ্ছে। সেখানে খাওয়াদাওয়া, সেবাশুশ্রূষার ব্যবস্থাপনা আছে। পরে হয়তো পিবিআই চাইলে তাকে হস্তান্তর করা হবে।
সাজানো নাটক!
ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার বওলা গ্রামের ঝোপ থেকে উদ্ধার হওয়া এক নারীর লাশ নিজের মায়ের বলে দাবি করেছিলেন রহিমার মেয়ে মরিয়ম মান্নান। ‘লাশ শনাক্তে’ গত শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে তিনি ফুলপুর থানায় যান। এ সময় মরিয়ম লাশটি তার মায়ের দাবি করে নিয়ে যেতে চান। সেখানে লাশের পরিহিত কাপড় দেখেন। এরপর মরিয়ম দাবি করেন, লাশটি তার মায়ের। পরে মরিয়ম মান্নান ফুলপুর থানায় ডিএনএ পরীক্ষার আবেদন করেন।
পুলিশের ব্রিফিংয়ে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে উপপুলিশ কমিশনার বলেন, ‘তিনি পরিকল্পিতভাবে করেছেন কি না, বা আবেগের বশবর্তী হয়ে করেছেন কি না, তা বলতে পারব না। তবে এটুকু বলতে পারি, সব রহস্য উন্মোচিত হবে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ কর্মকর্তার দাবি, রহিমা মূলত স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে ছিলেন।
রহিমাকে উদ্ধারের খবর পেয়ে রাতে দৌলতপুর থানায় আসেন অপহরণ মামলায় গ্রেপ্তার রফিকুল আলম ও নুরুল আলমের বাবা আনসার উদ্দিন আহমেদ। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, তাদের সঙ্গে জমির সীমানা নিয়ে মতবিরোধ থাকায় তার দুই ছেলের নামে মামলা দিয়ে হয়রানি ও সম্মানহানি করা হয়েছে। রহিমা ও তার সন্তানেরা অপহরণের নাটক সাজিয়েছে দাবি করে তিনি তাদের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।
একই মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া মহিউদ্দিন ও গোলাম কিবরিয়ার বড় ভাই নজরুল ইসলাম বলেন, পুরো বিষয়টা একটা সাজানো নাটক। রহিমা বেগমের সন্তানেরা পুলিশ ও সাংবাদিকদের মিথ্যা কথা বলে প্রায় এক মাস বিভ্রান্ত করেছে।
থানায় উপস্থিত থাকা রহিমা বেগমের বড় ছেলে মোহাম্মদ সাদী বলেন, মা উদ্ধার হওয়ায় তারা খুশি। তার পরিবারের কেউ অপহরণ নাটক সাজিয়েছে বলে তার কাছে মনে হয় না। তবে কাউকে হয়রানির উদ্দেশ্যে তার পরিবারের কেউ যদি কোনো অন্যায় করেছে—এমনটা প্রমাণিত হলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হোক।
এসডব্লিউ/এসএস/১১৫০
আপনার মতামত জানানঃ