অসলোভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ইরান হিউম্যান রাইটস (আইএইচআর) জানিয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে কমপক্ষে ৫০ জন মারা গেছেন। এরই মধ্যে ৮০টি শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে সরকারপন্থিরাও।
উল্লেখ্য, মাশা আমিনি নামের এক তরুণীকে সম্প্রতি গ্রেফতার করে ইরান পুলিশ। অভিযোগ ছিল ‘সঠিকভাবে’ হিজাব না পরার। গ্রেফতারের পর পুলিশি হেফাজতেই গত ১৬ সেপ্টেম্বর মারা যান মাশা। এ ঘটনার পর থেকেই বিক্ষোভের আগুনে জ্বলছে ইরান। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক নিহতের খবর পাওয়া গেছে। তবে প্রশ্ন উঠছে, এক তরুণীর মৃত্যু থেকেই কি কেবল এই তীব্র বিক্ষোভের জন্ম?
অনেকেই বলছেন, শোষণ-বঞ্চনার শিকার মানুষের জমে থাকা দীর্ঘদিনের ক্ষোভও ঘি ঢালছে আগুনে। এ বিক্ষোভেই রাইসি যুগের অবসান ঘটাবে কিনা, তা নিয়েও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। তবে এর মধ্য দিয়ে বিগত কয়েক বছরের মধ্যে ইরানের নেতৃত্ব যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তা স্পষ্ট।
যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে, মাশা আমিনি আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন এবং এ কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে। তবে তার পরিবার এবং ইরানের হাজারো মানুষের বিশ্বাস, পুলিশের নির্যাতনেই মারা গেছেন মাশা।
এমন এক সময়ে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যখন ইরানিরা হতাশাজনক এক সময় পার করছেন। কারণ দেশটির রাজনৈতিক অভিজাতদের ব্যাপক দুর্নীতি, ৫০ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতিসহ ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য, পারমাণবিক আলোচনায় অচলাবস্থা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার অভাব ইরানের বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে তীব্র হতাশার জন্ম দিয়েছে।
ইরানের সোশ্যাল সিকিউরিটি অর্গানাইজেশন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, ২০২১ সালের জুন মাস নাগাদ অন্তত আড়াই কোটি ইরানি দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছিলেন। এ সংখ্যা এখন আরও বেশি।
ইরানের ইসলামী প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে বিক্ষোভের ঘটনা এটিই প্রথম নয়। কিন্তু অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, চলমান বিক্ষোভ ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। কারণ এবার প্রতিবাদে নেমেছেন নারীরা, দেশটিতে যা বিরল।
ইসলামী বিপ্লব কী টিকে থাকবে?
ইরানে নাগরিক অধিকার বা স্বাধীনতা রক্ষা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বহু বছর ধরেই দেশটিতে নারীদের ওপর দমন-পীড়নের বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। তাদের দাবি, ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর সমাজের সর্বস্তরে সবচেয়ে বড় ক্ষতির শিকার হয়েছেন নারীরাই।
ইসলামী বিপ্লবের পরপরই ইরানের নারীদের জন্য হিজাব (মাথার স্কার্ফ) ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। এছাড়া ভ্রমণ, বাইরে কাজ করা এবং সাত বছরের বেশি বয়সী শিশুর হেফাজতের অধিকারও হারান তারা। এ নিয়ে তখন পুরুষ সমাজের কাছ থেকেও তেমন কোনো আপত্তি আসেনি।
তবে সময় বদলে গেছে উল্লেখ করে সুইডেনভিত্তিক ইরানি সমাজবিজ্ঞানী মেহরদাদ দারভিশপুর বলছেন, ইরানের চলমান বিক্ষোভে অনেক পুরুষও যোগ দিচ্ছেন। এর থেকে বোঝা যায় যে, সমাজ আরও প্রগতিশীল দাবির দিকে ধাবিত হয়েছে।
সাম্যের আহ্বান এবং ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দেশটিতে বিক্ষোভকারীদের প্রধান স্লোগান এখন- ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’। এছাড়াও আগের বিক্ষোভগুলোর তুলনায় চলমান এ বিক্ষোভ অনেক বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক।
২০০৯ সালে ইরানে তথাকথিত ‘গ্রীন মুভমেন্ট’ ছিল মূলত নির্বাচনী জালিয়াতির বিরুদ্ধে মধ্যবিত্তের প্রতিবাদ। আকারে বড় হলেও, এ বিক্ষোভ ছিল মূলত দেশটির প্রধান প্রধান শহরকে কেন্দ্র করে। এছাড়া ২০১৭ এবং ২০১৯ সালের অন্যান্য বড় বিক্ষোভ সীমাবদ্ধ ছিল কেবল দরিদ্র অঞ্চলগুলোর মধ্যে।
কিন্তু চলমান বিক্ষোভে মধ্যবিত্ত এবং শ্রমিক শ্রেণি উভয় পক্ষই অংশ নিয়েছে। তারা স্থানীয় বা জাতিগত সমস্যা থেকে আরও অন্তর্ভুক্তমূলক বিষয়ে চলে গেছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ইরানে একটি ‘মেগা-আন্দোলন’ জন্ম নিয়েছে। এর নেতৃত্বে নারীরা থাকলেও, তারা অন্যদেরও বিক্ষোভে টানতে সক্ষম হয়েছেন। তবে সব ছাপিয়ে যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা বেশি হচ্ছে তা হলো, হিজাব পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানানো। বলা হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে ‘অলঙ্ঘনীয় শাসনের’ এক ভাবমূর্তি ভেঙে দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা।
কী করবে ইরান সরকার?
ইরানের নেতৃত্বকেও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে চলমান এ বিক্ষোভ। এমনকি মাশা আমিনির মৃত্যু সরকারের কিছু কট্টর সমর্থককেও নাড়া দিয়েছে।
আলেমসহ দেশটির অনেক বিশিষ্ট নাগরিক নারীদের বিরুদ্ধে নৈতিকতা পুলিশের সহিংস কৌশল নিয়ে নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। ফলে সরকারের সামনে এখন দুটি বিকল্প রয়েছে। প্রথমত, হিজাব নিয়ে কঠোর নিয়ম পরিবর্তন করা, যা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের পরিচয়ের অংশ। কিন্তু এটি করলে তা শাসন পরিবর্তনের চূড়ান্ত দাবির আন্দোলনকে আরও উৎসাহিত করতে পারে বলেও শঙ্কা রয়েছে সরকারি মহলে।
দ্বিতীয়ত, কোনো কিছু পরিবর্তন না করে প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা অব্যাহত রাখলে তা সাময়িকভাবে অস্থিরতাকে হয়তো শান্ত করতে পারবে। কিন্তু এই পথে হাটলে তা ক্রমবর্ধমান ক্রোধের আগুনে ঘি ঢালা হবে, দীর্ঘমেয়াদে যা আরও তীব্র আন্দোলনের জন্ম দেবে।
জানা গেছে, দাঙ্গা পুলিশ যারা এখন বিক্ষোভ দমন করছে তাদের অনেকেই অর্থনৈতিক অসুবিধায় ভুগছেন এবং বর্তমান শাসনকে সেভাবে সমর্থনও করছেন না। ফলে বিক্ষোভ অব্যাহত থাকলে একপর্যায়ে তারা পক্ষ পরিবর্তন করতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে। তার ওপর দেশটির সর্বোচ্চ নেতা ৮৩ বছর বয়সী আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির অসুস্থতাও ভাবাচ্ছে উভয় পক্ষকে।
কারণ খামেনির উত্তরসূরি যিনি হবেন তিনি কট্টর সমর্থকদের সমর্থন বজায় রাখতে পারবেন কিনা, তা-ও স্পষ্ট নয়। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চলমান বিক্ষোভ বর্তমান শাসকদের চূড়ান্ত অধ্যায় নাও হতে পারে। তবে এটি যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
সংঘাত একদিকে যেমন প্রাণহানির কারণ হচ্ছে, তেমনি ফাটল ধরাচ্ছে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায়ও। ইরানের বর্তমান সমাজব্যবস্থায় ক্ষুব্ধ দেশটির বেশিরভাগ নাগরিক, যারা এখন ভিন্নধারার জীবনযাপনে আগ্রহী।
কীভাবে দেখছে গোটা বিশ্ব?
মাশা আমিনির মৃত্যুতে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিশ্ব নেতারা। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনেও ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির ব্যাপক সমালোচনা করেছেন তারা।
অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংবাদমাধ্যমকে জানায়, হিজাবকাণ্ডে পুলিশি হেফাজতে মাশা আমিনির মৃত্যুতে ক্যানবেরা গভীরভাবে শোকাহত এবং মৌলিক স্বাধীনতার জন্য বিক্ষোভে দমন-পীড়নের বিষয়ে তারা উদ্বিগ্ন।
মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ইরানে নারীদের প্রতি আচরণ একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা নিয়মিতভাবে তেহরান এবং ক্যানবেরার কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনায় এবং বহুপাক্ষিক ফোরামে ইরানে নারীদের প্রতি উল্লেখযোগ্য বৈষম্য নিয়ে আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছি।
ইরানের নৈতিকতা পুলিশ এবং কিছু নিরাপত্তা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর মাশা আমিনির মৃত্যুকে ‘ইরান সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে তার নিজ জনগণের বিরুদ্ধে আরেকটি বর্বরতা’ বলে বর্ণনা করেছেন মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি জ্যানেট এল. ইয়েলেন।
এছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তার ভাষণে বলেছেন, ‘আমরা ইরানের সাহসী নাগরিক এবং নারীদের পাশে দাঁড়িয়েছি, যারা এই মুহূর্তে তাদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত করার জন্য বিক্ষোভ করছেন।’
মাশা আমিনির মৃত্যুতে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে জার্মানি, সুইডেন, চিলি, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ।
এসডব্লিউ/এসএস/০৯০৫
আপনার মতামত জানানঃ