আজ ১৫ সেপ্টেম্বর, ‘আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস’। প্রতিবছর ১৫ সেপ্টেম্বর দিবসটি পালিত হয়। গণতন্ত্রের গুরুত্ব চিহ্নিত করতে এবং গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালন করা হয়।
গণতন্ত্রের আদর্শ কেবলমাত্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, সুশীল সমাজ, জাতীয় শাসক সংস্থা এবং ব্যক্তিবর্গের পূর্ণ অংশগ্রহণ, সহযোগিতা এবং সমর্থন সহ সকলের দ্বারা উপভোগ করার বাস্তবতা হিসাবে উপলব্ধি করা যেতে পারে।
২০০৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে গণতন্ত্র সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি এবং গণতন্ত্র চর্চাকে উৎসাহিত করার জন্য প্রচলিত একটি বিশেষ দিন পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এর পর থেকেই প্রতি বছর ১৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস পালিত হয়ে আসছে।
এ বছর দিবসটিতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষ্যে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস একটি ভিডিও বার্তা দিয়েছেন, যেখানে তিনি বলেছেন, মুক্ত গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে না।
এ দিবসে এসে দেখা যাচ্ছে, গণতন্ত্র সংশ্লিষ্ট সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান পেছনে। বছর বছর কোনো সূচকে বাংলাদেশ সামান্য এগোয়, কোনো সূচকে পেছায়। তবে বড় উন্নতি দেখা যায় না।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) মাপকাঠিতে বাংলাদেশ একটি ‘হাইব্রিড’ শাসনব্যবস্থার দেশ।
ইআইউয়ের শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী, ‘হাইব্রিড’ শাসনব্যবস্থার দেশে প্রায়ই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়। দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ও দুর্বল আইনের শাসন, দুর্বল নাগরিক সমাজ ‘হাইব্রিড’ ধরনের শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য।
এ ধরনের দেশে বিচারব্যবস্থা স্বাধীন নয় এবং সাংবাদিকদের হয়রানি ও চাপ দেওয়া হয়।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস ফ্রন্টিয়ার্সের মুক্ত গণমাধ্যম সূচক–২০২২ অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ১০ ধাপ পিছিয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬২তম দাঁড়িয়েছে।
ফ্রিডম হাউস প্রকাশিত ২০২১ সালের সূচকে বাংলাদেশকে রাখা হয়েছে ‘আংশিক মুক্ত’ (পার্টলি ফ্রি) দেশের কাতারে। এতে ১০০ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে মাত্র ৩৯ নম্বর। এতে ৪০ নম্বরের রাজনৈতিক অধিকারের মধ্যে ১৫ এবং ৬০ নম্বরের নাগরিক অধিকারের মধ্যে ২৪ নম্বর পেয়েছে বাংলাদেশ। ওই সূচকে অবশ্য দুর্নীতিকে গুরুতর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ ছাড়া নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারাকেও বড় দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়েছে।
এখানে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা ছিল। এর জন্য কখনো কখনো নির্বাচনও হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এখানে গণতন্ত্র কখনো দানা বাঁধেনি।’
দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ জন্য স্বাধীন সংবাদমাধ্যম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত। তবে দেশে বিদ্যমান ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ (আইসিটি) সাংবাদিক নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও কথা বলেছে।
সম্প্রতি দেশের আইসিটি এবং ওটিটি নিয়ন্ত্রণ আইনের খসড়াকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতিসম্মত করতে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর। গত সোমবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় মানবাধিকার পরিষদের ৫১ তম অধিবেশনে বিষয়টি তোলেন সংস্থার ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার নাদা আল নাশিফ। দেশের বুদ্ধিজীবী মহল থেকেও এ নিয়ে বিভিন্ন সময় কথা উঠেছে। কিন্তু তেমন বদল হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘আমাদের গণতান্ত্রিক চিন্তা এবং দেশে রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রের নামে যে কাজ করছে, এগুলো দিয়ে গণতন্ত্রের কিছুই রক্ষা পাচ্ছে না। বরং গণতন্ত্রবিরোধী নানা চিন্তা সামনে আসছে।’
তারা বলেন, ‘নির্বাচিত সরকার এলেই গণতন্ত্র হবে, এমন একটা ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তার আগে গণতন্ত্রের আদলে দল গঠন দরকার। দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা থাকা দরকার। এদিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থা নিতান্তই খারাপ। এখানে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা ছিল। এর জন্য কখনো কখনো নির্বাচনও হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এখানে গণতন্ত্র কখনো দানা বাঁধেনি।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাধীনতা আমাদের সব আশা পূর্ণ করেনি। দারিদ্র্যকে অনেকটা তাড়িয়েছে। দুর্নীতিকে তাড়াতে পারেনি। দুর্নীতি আরও বড় আকারে দেখা দিয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সন্ত্রাস। ৫০ বছরে আমাদের অনেক উন্নয়ন ঘটেছে। তার ফসল খেয়ে ফেলছে এ দুর্নীতি ও সন্ত্রাস। আগে যুদ্ধটা ছিল বিদেশি শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে। এখন তাদের স্থান দখল করেছে দেশি শাসক-শোষক। তারা আরও ভয়ংকর।
তারা বলছেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের এ পঙ্গুত্ব দূর করার জন্য একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক বিরোধী দল চাই। একটি দল দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকলে তার ভেতর ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রবণতা দেখা দেয়। দুর্নীতি জন্ম নেয়। বাংলাদেশে আজ সেই অবস্থা। এ অবস্থা থেকে দেশকে উদ্ধারের একমাত্র পথ গণতন্ত্রের পঙ্গুত্ব দূর করা এবং স্বাধীনতার মূল আদর্শগুলো ধর্মান্ধদের কবল থেকে মুক্ত করা। এ লক্ষ্যের পথে আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ধীরে ধীরে চেতনা জাগ্রত হচ্ছে এটাই আশার কথা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫১
আপনার মতামত জানানঃ