রাজধানীর গুলশানের একটি ফ্ল্যাটে তিনটি শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) চালান আবু সালেহ মাহমুদ শরীফ। তিনটি এসির সঙ্গে ফ্যান, লাইটসহ অন্য প্রয়োজনীয় ইলেকট্রনিক যন্ত্র রয়েছে। এত কিছু ব্যবহার করার পরেও তার মাসে বিদ্যুতের ব্যবহার ‘শূন্য ইউনিট’। ১০ মাস ধরে তিনি বিদ্যুৎ বিল দিয়েছেন সংযোগের জন্য ন্যূনতম চার্জ ২০৯ টাকা। এর আগে তিন মাস ১ ইউনিট করে খরচ করায় দিয়েছেন ২১৪ টাকা করে।
তিনি আর কেউ নন, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের উপমহাব্যবস্থাপক। তিনি মূলত মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগের দায়িত্বে আছেন। তিনি গুলশানে তিতাস গ্যাসের অফিসার্স কোয়ার্টারের একটি ভবনের তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটে থাকতেন। বর্তমানে চতুর্থ তলার একটি ফ্ল্যাটে আছেন।
তবে ওই ভবনের নিচতলার একটি ঘরে থাকেন একই প্রতিষ্ঠানের একজন নিরাপত্তাকর্মী। তিনি বাসায় একটি ফ্যান ও লাইট ব্যবহার করেন। কিন্তু সালেহ মাহমুদ শরীফের বিদ্যুৎ খরচ যখন শূন্য এসেছে, সে মাসগুলোতেই তার বিদ্যুৎ বিল এসেছে ১৬ হাজার থেকে ২২ হাজার টাকা পর্যন্ত।
তিতাস গ্যাস সূত্রে জানা গেছে, এই অফিসার্স কোয়ার্টারের নিচতলার সব ঘর এবং যেসব ফ্ল্যাট খালি থাকে, সেগুলোর বিদ্যুৎ বিল তিতাসের স্টেশন কন্ট্রোল শাখা থেকে পরিশোধ করা হয়। আর কর্মকর্তাদের বিদ্যুৎ বিল তারা নিজেরাই পরিশোধ করেন। আবু সালেহ মাহমুদ শরীফ যে ভবনে থাকেন, সেটিতে পাঁচটি মিটারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। ২০ জুন স্টেশন কন্ট্রোল শাখা থেকে আবু সালেহ মাহমুদ শরীফের শূন্য বিল ও কম বিল পরিশোধের বিষয়টি জানানো হয়।
সেখানে থেকে বলা হয়, আবু সালেহ মাহমুদ শরীফ ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর থেকে গত ৪ মার্চ পর্যন্ত কোয়ার্টারের তৃতীয় তলার ওই ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে বসবাস করেছেন। পরে তিনি ফ্ল্যাটটি সংস্কারের জন্য গত ৫ মার্চ চতুর্থ তলায় ওঠেন। তৃতীয় তলায় থাকায় সময় তার বিদ্যুৎ বিল অস্বাভাবিক ও অসামঞ্জস্য ছিল। এর মধ্যে ২০২০ সালের মার্চ থেকে ১০ মাস কোনো বিদ্যুৎই ব্যবহার করেনি বলে দেখা গেছে মিটারে।
একই সময় নিরাপত্তা প্রহরীর বিল ২২ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছে। আবার আবু সালেহ মাহমুদ শরীফ চতুর্থ তলায় ওঠার পর বিদ্যুৎ বিল বেড়ে ১২–১৩ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছে। আবু সালেহ মাহমুদ শরীফের বিদ্যুৎ বিলের এই অসংগতি খতিয়ে দেখতে গত ১৯ জুলাই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে তিতাস গ্যাস লিমিটেড। কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্য প্রতিবেদন দিতে বলা হলেও এখনো তারা তা দেয়নি।
কী বলছেন মাহমুদ শরীফ?
এমন বিদ্যুৎ বিল আসার কারণ জানতে চাইলে আবু সালেহ মাহমুদ শরীফ বলেন, ‘আমার বিদ্যুৎ বিল নিয়ে কোনো ঝামেলা হয়নি। আমার পেছনে লেগেছে। আমার সামনে পদোন্নতির বিষয় আছে। আমি যে ফ্ল্যাটে আছি, সেখানে ওঠার জন্য একজন এসব নোংরামি করছে।’ বাসায় কী কী বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম চলে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার বাসায় তিনটি এসি চলে, লাইট ও ফ্যান চলে।’
তাহলে মাসে আপনার বিদ্যুৎ ব্যবহার শূন্য ইউনিট কীভাবে হয় এবং অসংগতিপূর্ণ এই বিলের কথা জানাননি কেন—প্রশ্ন করা হলে আবু সালেহ মাহমুদ শরীফ বলেন, ‘দেখার জন্য অন্য অনেক সংস্থা আছে।’ তিনি বলেন, ‘আমি আমার কোম্পানির শুদ্ধাচার বিষয়ক ফোকাল পয়েন্ট। এবার ১৩টি কোম্পানির পক্ষ থেকে আমরা শুদ্ধাচার পুরস্কার পাচ্ছি। আমরা প্রথম হয়েছি।’
নিজের বিদ্যুৎ বিল নিয়ে কিছু না বললেও নিচতলায় কেন বেশি বিল এসেছে, তার পক্ষে একটি যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন আবু সালেহ মাহমুদ শরীফ। তিনি বলেন, নিচতলায় আসলে ২৫টি লাইট ও তিনটি ফ্যান চলে। এ জন্য বেশি বিল এসেছে।
যা বলছে তিতাস কর্তৃপক্ষ
তবে তার এ বক্তব্য নাকচ করে তিতাস গ্যাসের স্টেশন কন্ট্রোল শাখার প্রকৌশলী মো. মহিদুর রহমান বলেন, একটি কক্ষে কীভাবে ২৫টা লাইট জ্বলবে? তিনি বলেন, আবু সালেহ মাহমুদ শরীফের বাসার মিটারটি ছিল ‘মাদার মিটার’। যদি মিটার নষ্ট হয়ে থাকে আর প্রায় এক বছর বিল না দেন, তাহলে সেটা জানাবেন না কেন? আর যদি নষ্ট না হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই ‘মিটার টেম্পারিং’ হয়েছে। তার বাসায় তিন-চারটি এসি চলে। এর কোনো বিদ্যুৎ বিল আসেনি। আর যিনি নিরাপত্তাকর্মী, তার বিল আসে ২২ হাজার টাকা পর্যন্ত।
আবু সালেহ মাহমুদ শরীফের মিটার পরিবর্তনের পর তার বিদ্যুৎ বিল ১৩ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছে বলে জানান প্রকৌশলী মহিদুল রহমান। তিনি বলেন, ‘এখন তদন্ত কমিটি কী প্রতিবেদন দেয়, তার ওপর সব নির্ভর করে। এত বড় ফ্ল্যাটে তিনটি এসি ব্যবহার করে বিলে শূন্য ইউনিট কেন আসবে?’
ঘটনা তদন্তে তিতাস গ্যাস তিন সদস্যের যে কমিটি করেছে, তার আহ্বায়ক হিসেবে আছেন কোম্পানির উপমহাব্যবস্থাপক (পুরকৌশল বিভাগ) প্রকৌশলী মো. সফিকুল ইসলাম। তদন্ত প্রতিবেদন এখনো জমা পড়েনি কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো বিষয়টি তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে। তদন্তে কী পাওয়া গেল, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিল কেন এল না বা কেন কম এল, সে বিষয়টি আমরা দেখছি।’ কবে প্রতিবেদন দেবেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দ্রুতই দিয়ে দেব।’
এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির সদস্যসচিব ও উপব্যবস্থাপক (পরিবেশ ও নিরাপত্তা শাখা, পরিকল্পনা বিভাগ) সাবরিনা আফরিন বলেন, ‘আমরা নিজেদের কাজ নিয়ে অনেক ব্যস্ত, তদন্ত করা এক্সট্রা প্রেশার, তাই দেরি হচ্ছে।’
এসডব্লিউ/এসএস/১১০৫
আপনার মতামত জানানঃ