সুমিত রায়
গত সপ্তাহের শেষের দিকে, গ্যাজপ্রম ঘোষণা করেছিল যে রাশিয়া থেকে ইউরোপে চলমান বৃহত্তম গ্যাস পাইপলাইন নর্ড স্ট্রিম ২ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। এটা মোটেও বিস্ময়কর কিছু ছিল না। মূলত, ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইউরোপের প্রতিটি পাইপলাইনে কিছু বিঘ্ন দেখা গেছে এবং গ্যাজপ্রম জুন থেকে নর্ড স্ট্রিমের মাধ্যমে প্রবাহ হ্রাস করছে। যাইহোক, গত বছরের হিসাব অনুযায়ী, নর্ড স্ট্রিম দিয়ে ইউরোপের রাশিয়ান গ্যাস আমদানির প্রায় ৩৫% এবং ইউরোপের মোট আমদানির ১৫% আমদানী হয়। এগুলোর বন্ধ হয়ে যাওয়া ইউরোপের জন্য ভাল খবর নয়, যেখানে ইতিমধ্যেই গ্যাসের দাম এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যা আগে কোনদিন হয়নি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইউরোপে শীতকালের জন্য পর্যাপ্ত গ্যাস আছে কিনা।
শুরু করা যাক, ইইউতে রাশিয়ান গ্যাস আমদানি বিঘ্নিত হবার দিকটি নিয়ে। প্রথম যে বিষয়টি উল্লেখ করা দরকার তা হলো, রাশিয়া ইউরোপের একক বৃহত্তম গ্যাস উৎস এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মোট গ্যাস আমদানির ৪০% থেকে ৫০% আসে রাশিয়া থেকেই। এখন, এই গ্যাসের প্রায় ৮৫% পাইপলাইনের মাধ্যমে আসে, যেগুলোর মধ্যে চারটি প্রধান পাইপলাইন সিস্টেম রয়েছে – (১) নর্ড স্ট্রিম (কখনও কখনও নর্ড স্ট্রিম ১ নামে পরিচিত) বাল্টিকের মধ্য দিয়ে সরাসরি জার্মানিতে যায়, (২) ইয়ামাল ইউরোপ বেলারুশের মধ্য দিয়ে পোল্যান্ডে এবং তারপরে জার্মানিতে চলে যায়, (৩) ইউক্রেন ট্রানজিট সিস্টেম হলো ইউক্রেন এবং মধ্য ইউরোপে চলমান পাইপলাইনগুলির একটি ওয়েব, এবং (৪) তুর্কি স্ট্রিম যা কৃষ্ণ সাগরের মধ্য দিয়ে তুরস্কে চলে যায়। গত ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পুতিন ধীরে ধীরে এসব পাইপলাইনের ট্যাপগুলো বন্ধ করে দিচ্ছেন। পোল্যান্ড এবং বুলগেরিয়া রুবলে অর্থ প্রদান করতে অস্বীকার করার পরে রাশিয়া এপ্রিলে ইয়ামাল ইউরোপ বন্ধ করে দেয় এবং রাশিয়ান সেনাবাহিনী ইউক্রেইনের গ্যাস কম্প্রেসার স্টেশন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিলে ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ মে মাসের প্রথম দিকে ইউক্রেনীয় ট্রানজিট সিস্টেমের মাধ্যমে প্রবাহ হ্রাস করে। তারপর জুনের মাঝামাঝি সময়ে, গ্যাজপ্রম নর্ড স্ট্রিমের মধ্য দিয়ে প্রবাহ হ্রাস করে ও দাবি করে যে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে গ্যাস প্রবাহের জন্য প্রয়োজনীয় টারবাইন কানাডায় আটকে গেছে। তারপর এক সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় পরে, তারা ঘোষণা করে যে নর্ড স্ট্রিম নির্ধারিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ করা হবে। যদিও এটি জুলাই এবং আগস্টে সংক্ষিপ্তভাবে চালু হয়েছিল, তারপরও এটি কম পাওয়ারে গ্যাস পাম্প করছিল। গত সপ্তাহেই, গাজপ্রম ঘোষণা করেছিল যে তারা এটি অনির্দিষ্টকালের জন্য গ্যাস প্রবাহ বন্ধ করে দেবে, এর জন্য তারা পোর্টোভায়া কম্প্রেসর স্টেশনের প্রধান গ্যাস টারবাইনে তেল লিকের কারণ দেখায়। কিন্তু এই দাবিটি সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য ছিলনা, প্রথমত, পুতিনের ইউরোপে গ্যাস প্রবাহ সীমিত করার জন্য একটি সুস্পষ্ট আগ্রহ রয়েছে, যেমনটি তিনি ইতিমধ্যেই করেছেন। দ্বিতীয়ত, টারবাইন তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ করার সংস্থা সিমেন্স বলেছিল যে এই ফুটোগুলো সাধারণ এবং সাধারণত গ্যাস প্রবাহকে প্রভাবিত করে না। আর তারপর রাশিয়ার ক্রেমলিনের স্পোকসম্যান দিমিত্রি পেশচভ স্বীকার করেন যে নর্ডস্ট্রিম ১ -এ গ্যাস সাপ্লাই বন্ধ করার একমাত্র কারণ ছিল স্যাংকশন। যাইহোক এর সাথে ইয়ামাল ইউরোপ এবং ইউক্রেন ট্রানজিট সিস্টেমেও গ্যাস প্রবাহে বিঘ্ন ঘটার ফলে সব মিলে ইউরোপে রাশিয়ান গ্যাস প্রবাহ পূর্বের চেয়ে ৮০%-এ কমে আসে। ঘোষণাই করে যে স্যাংকশন তুলে না নেয়া অব্দি রাশিয়া ইউরোপে আর গ্যাস সরবরাহ করবে না। এখন প্রতিদিন ৮০ মিলিয়ন ঘনমিটারেরও কম হয়ে যায়, যেখানে গত বছরের একই সময়ে, প্রতিদিন প্রায় ৪০০ এমসিএম-এ প্রায় পাঁচগুণ বেশি ছিল। সর্বোপরি, এর মানে হল যে ইউরোপীয় পাইপলাইন রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি করে, যা সাধারণত ইউরোপের সমস্ত গ্যাস আমদানির প্রায় ৪০% এর জন্য দায়ী, তা এখন ৮০% হ্রাস পেয়েছে।
স্পষ্টতই, এই ঘাটতিটি ইউরোপীয় গ্যাসের দামকে বর্তমানে স্বাভাবিকের চেয়ে কমপক্ষে ১০ গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এটা ইউরোপে শীতকালে গ্যাস সরবরাহ সম্পর্কে কিছু উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। (ইইউ এজন্য রাশিয়ার জ্বালানিতে প্রাইস ক্যাপ বসিয়ে দাম কমাতে চাইছে, যেখানে রাশিয়া তাদের থ্রেট দিচ্ছে যে এটা হলে রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস, তেল, কয়লা সাপ্লাই পুরোপুরি বন্ধ করে দেবে। আগেই বলেছি যে রাশিয়া এগুলো করতে পারছে কারণ ভারত ও চীনের মত দেশগুলো প্রচুর পরিমাণে রাশিয়ার জ্বালানি কিনছে। এদিকে রাশিয়া থেকে গ্যাস আসা কমে যাবার পর ইউরোপে এখন সেই রাশিয়ার গ্যাসই অনেক বেশি দামে কেনা শুরু করেছে চীন থেকে। এতে চীনের লাভ।) যাই হোক, বর্তমানে প্রায় অর্ধেক ইউরোপীয় পরিবারকে উষ্ণ রাখার জন্য প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহৃত হয় এবং এটি ইউরোপীয় পরিবারগুলোর জন্য শক্তির প্রভাবশালী উৎস, যা সমস্ত পরিবারের শক্তি খরচের প্রায় ৩০% দান করে। যদি ইউরোপে রাশিয়ান গ্যাস প্রবাহ কম থাকে (যা এই মুহুর্তে দেখা যাচ্ছে) তাহলে ইউরোপীয় পরিবারগুলি এই শীতে উষ্ণ থাকার ব্যাপারটা কঠিন হয়ে যাবে। এখানেই আসছে আরেকটি প্রসঙ্গ, ইউরোপের গ্যাস স্টোরেজ বা গ্যাস সঞ্চয়।
মূলত, কয়েক মাস আগে, ইউরোপীয় রাজনীতিবিদরা বুঝতে পেরেছিলেন যে গ্যাসের ঘাটতি একটি সমস্যা হতে পারে। জুনের শেষের দিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি পরিকল্পনা তৈরি করে যাতে প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রকে এই শীতের মধ্যে তাদের গ্যাস ধারণ ক্ষমতার কমপক্ষে ৮০% এবং তারপরে পরবর্তী শীতকালে ৯০% পূর্ণ করতে হবে। সব দেশের এই স্টোরেজ ক্ষমতা নেই, বিশেষ করে আয়ারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া, গ্রীস, লুক্সেমবার্গ এবং স্লোভেনিয়াকে এর জন্য এর পরিবর্তে তাদের প্রতিবেশী সদস্য দেশগুলোর সাথে চুক্তিতে যেতে হয়েছিল। যেমন নিজে গ্যাস কিনে অন্য আরেক দেশে সংরক্ষণ করার চুক্তি, যা গ্যাসের শর্টফলের সময় তারা ব্যবহার করতে পারবে। সদস্য রাষ্ট্রগুলো সেপ্টেম্বরের জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন লক্ষ্যও নির্ধারণ করে, যা তারা ১লা সেপ্টেম্বরের মধ্যে পূরণ করার লক্ষ্য তৈরি করে। কিন্তু সদস্য রাষ্ট্রগুলো তাদের লক্ষ্যপূরণ করতে সক্ষম হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় ছিল, কারণ বছরের শুরুতে গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের স্টোরেজের স্তর সর্বকালের মধ্যে সবচেয়ে নিচে ছিল। ১লা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, বেশিরভাগ সদস্য রাষ্ট্রই তাদের ৮০% লক্ষ্যমাত্রা পূরণের পথে রয়েছে। লাটভিয়া ছাড়া ইইউ-এর প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রই ১লা সেপ্টেম্বরের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে সক্ষম হয়, যা অধিকাংশ দেশের জন্যই ছিল ৬০%। অনেক দেশই ইতিমধ্যে তাদের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি গ্যাস সংগ্রহ করে ফেলেছে। লাটভিয়া লক্ষ্যমাত্রা পুরণ করতে পারেন, কারণ তারা আগস্টের প্রথম দিকে গ্যাজপ্রম এর গ্যাস সরবরাহ এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ করে দিয়েছিল, যার ফলে তাদের গ্যাস সঞ্চয় কম হয়েছে।
সামগ্রিকভাবে বলা যায়, ইইউ এর গ্যাস স্টোরেজ ইতিমধ্যে ৮০% এরও বেশি পূর্ণ, আর তাদের স্টোরেজে ইতিমধ্যে প্রায় ৯০০ টেরাওয়াট ঘন্টা মূল্যের শক্তি রয়েছে, যা গত বছর যে জায়গায় ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু এটা যথেষ্ট হবেনা। ২০১৯ সালে ইউরোপ শুধুমাত্র জানুয়ারিতেই ৬০০ টেরাওয়াট ঘন্টা ব্যবহার করেছিল। তবে কার্ভটাকে মসৃণ করার জন্য এবং দামগুলি পরিচালনাযোগ্য স্তরে রাখার জন্য এটি যথেষ্ট বলেই মনে হয়। সর্বোপরি, ইউরোপ এই শীতের জন্য আশ্চর্যজনকভাবে ভাল অবস্থানেই আছে। ইউরোপে গ্যাসের দাম যে সম্প্রতি পড়ে গেছে, অনেকগুলো কারণের মধ্যে এটি একটি হতে পারে। বিনিয়োগকারীরা আর ভয় পাচ্ছে না যে, ইউরোপ এই শীতে গ্যাসের জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে, যেমনটি তারা কয়েক সপ্তাহ আগে করেছিল।
ইইউ এর বাইরে ইউরোপে আরেকটি দেশ রয়েছে, যার কথা বিবেচনা করাটাও দরকারী। দেশটি হচ্ছে যুক্তরাজ্য। এই দেশ নিয়ে বিশেষভাবে বলা দরকার কারণ ইউরোপে পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্যাস সঞ্চিত থাকতে পারে বটে, তবে যুক্তরাজ্য কিছুটা কঠিন জায়গায় রয়েছে। কারণ দেশটি ২০১৭ সালে তাদের সবচেয়ে বড় গ্যাস স্টোরেজ সাইটটি বন্ধ করে দেয়। ইউরোপে অন্যান্য যে কোন দেশের তুলনায় যুক্তরাজ্যের পার ক্যাপিটা গ্যাস কনসাম্পশন সবচেয়ে বেশি। কিন্তু যুক্তরাজ্যে সঞ্চিত রয়েছে মাত্র ৯ টেরাওয়াট ঘণ্টার গ্যাস। রেফারেন্সের জন্য বলছি, তুলনায় এখন জার্মানিতে আছে ২০৯ টেরাওয়াট ঘন্টার গ্যান্স স্টোরেজ, ফ্রান্সে আছে ১২২ টেরাওয়াট ঘণ্টার গ্যাস স্টোরেজ, এবং ইতালিতে ১৬২ টেরাওয়াট ঘণ্টার গ্যাস স্টোরেজ। (ব্রেক্সিট করে কি তবে অনেক বড় ভুল হয়ে গেল?!)। তবে যুক্তরাজ্যের বেশিরভাগ গ্যাস সরবরাহকারী সংস্থা সেন্ট্রিকা (Centrica) যুক্তরাজ্যের গ্যাস স্টোরেজ কিছুটা বাড়ানোর জন্য কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। তারা সম্প্রতি নরওয়ে এবং ডেলফিন মিডস্ট্রিম উভয়ের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, (ডেলফিন মিডস্ট্রিম সংস্থাটি লুইজিয়ানা থেকে মার্কিন প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রি করে)। এরা স্পষ্টতই পূর্বে উল্লিখিত বন্ধ হওয়া স্টোরেজ সুবিধাটি পুনরায় চালু করার বিষয়টিও বিবেচনা করছে। এতদসত্ত্বেও যুক্তরাজ্য আসছে শীতকালের জন্য গ্যাস শর্টেজ নিয়ে বেশ ঝুঁকিতেই থাকবে, যা নতুন ক্ষমতা লাভ করা প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের জন্য আরও একটি চ্যালেঞ্জ। আমি লিজ ট্রাস নিয়ে আমার লেখাটিতে দেখিয়েছিলাম যে তিনি অনেকগুলো ইকোনমিক রিফর্ম নিয়ে আসছেন, গ্রিন লেভিস বন্ধ করছেন, ফ্র্যাকিং বা জ্বালানি উত্তোলন বাড়াচ্ছেন, বিভিন্ন রকমের শক্তির অলটার্নেটিভের কথা ভাবছেন, ডেফিসিটে গিয়ে হলেও গভর্নমেন্ট স্পেন্ডিং বাড়াচ্ছেন, সিভিল সার্ভিসে স্পেন্ডিং কমিয়ে দিচ্ছেন, ট্যাক্স কমিয়ে দিচ্ছেন। এগুলো সবকটাকেই যুক্তরাজ্যের এই সংকটের সাথে সম্পর্কিত করা যায়। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, পুতিনের বাধা সত্ত্বেও ইউরোপ এই শীতের জন্য বেশ ভালোভাবে প্রস্তুত। কিন্তু যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায় না।
আপনার মতামত জানানঃ