দুই দিন বন্ধ থাকার পর বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্ত এলাকায় আবারও মিয়ানমারের গোলাগুলি শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ৮টার দিকে তুমব্রু সীমান্তে থেমে থেমে চালানো গুলির বিকট শব্দে সীমান্তের বাসিন্দাদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। দুপুর ১২টা পর্যন্ত গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে।
আজ মঙ্গলবার (৬ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টা দিকে থেমে থেমে চালানো এই ভারী গুলি বর্ষণের শব্দে সীমান্তে বসবাসকারীদের মাঝে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো.জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, ‘সীমান্তে দুই দিন গুলি বর্ষণ বন্ধ থাকায় মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরেছিল। কিন্তু হঠাৎ করে সকাল থেকে আবারো গোলাগুলি হওয়ায় ফের ভয়ের মধ্যে আছেন সীমান্তের লোকজন। কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছে’।
তুমব্রু সীমান্তের বাসিন্দা মাহমুদুল হক বলেন, ‘দুই দিন বন্ধ থাকার পর বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে আবারও সকাল থেকে ভারী গুলি করা হচ্ছে। গুলির বিকট শব্দে এখানকার মানুষজন ভয়ভীতির মধ্যে রয়েছে। তবে আকাশে এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের হেলিকপ্টার বা যুদ্ধবিমান উড়তে দেখা যায়নি।’
এ বিষয়ে বান্দরবানের পুলিশ সুপার (এসপি) তারিকুল ইসলাম তারিক জানান, সীমান্তে আবারো গোলাগলি খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে ভয়ের কোন কারণ নেই। আমরা সীমান্তে সর্তক অবস্থানে রয়েছি।
উল্লেখ্য, গত এক মাস ধরে সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজ করছে। গত ২৮ আগস্টে পর পর দুইটি মর্টারসেল এসে পড়েছিল সীমান্তের তুমব্রু উত্তরপাড়া এলাকায়। এরপর ৩ সেপ্টেম্বর আরও দুটি মর্টারসেল পড়ে বাংলাদেশের বাইশপারি এলাকায়।
মিয়ানমারের যে এলাকাটিতে সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির লড়াই চলছে, সেটির নাম ‘খা মং সেক’ পাহাড়। ওই পাহাড়ের দেড় কিলোমিটার দূরে (উত্তরে) বাংলাদেশের তুমব্রু বাজার। এই বাজার থেকে মিয়ানমারে হেলিকপ্টার, জেট ফাইটারের ওড়াউড়ি, গুলিবর্ষণের দৃশ্য দেখা যায়। তুমব্রু বাজারের কোনারপাড়া এবং মিয়ানমারের ‘খা মং সেক’ পাহাড়ের মাঝখানের জায়গাটুকু নো ম্যান্স ল্যান্ড।
এখানে (শূন্যরেখা) আশ্রয়শিবির গড়ে তুলে পাঁচ বছর ধরে বাস করছেন রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত ৬২১টি পরিবারের ৪ হাজার ২০০ জনের বেশি রোহিঙ্গা। স্থলযুদ্ধের পাশাপাশি আকাশ থেকে ছোড়া গুলি, মর্টার শেল ও বোমা নিক্ষেপের ঘটনায় আতঙ্কিত তাঁরা।
পুলিশ ও সীমান্ত সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা একাধিক সূত্র জানায়, গত ২৮ আগস্ট দুপুরে মিয়ানমারের দিক থেকে ছোড়া দুটি মর্টার শেল বাংলাদেশ অংশে এসে পড়েছিল। তবে সেগুলো অবিস্ফোরিত হওয়ায় এতে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা শেলগুলো নিষ্ক্রিয় করেন। এ ঘটনায় সেদিন বিকেলে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছিল ঢাকা। কিন্তু তৃতীয় দফায় আজও বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এসে পড়ছে মিয়ানমারের ছোড়া একাধিক মর্টার শেল ও গুলি।
বিশেষজ্ঞের মতামত
এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, আমি মনে করি, বিষয়টি আঞ্চলিক ফোরামে আনা দরকার। প্রধানমন্ত্রী দিল্লি গেছেন। মিয়ানমারের সঙ্গে দিল্লির ভালো সম্পর্ক। প্রধানমন্ত্রীর সফরে এটি উত্থাপন করা দরকার। এমনকি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদেও এটি নিয়ে আলোচনা করা দরকার। মিয়ানমার বাংলাদেশকে উত্তেজিত করতে চাইছে। এটি না বোঝার কোনো কারণ নেই।
রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরা যাতে আরও পেছাতে পারে, তার জন্য বিষয়টি জটিল করতে চাইছে হয়তো। সংঘর্ষ বা সামরিক তৎপরতায় বাংলাদেশকে বিরক্ত করতে পারলে তারা লাভ দেখছে। এ কারণেই আমি মনে করি, যত দ্রুত পারে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসুক। এটি করতে পারলে মিয়ানমারের ওপর এক ধরনের চাপ আসবে।
ইমতিয়াজ আহমেদ আরও বলেন, গত ক’বছরে মিয়ানমারের আচরণ থেকে আমাদের বুঝতে হবে যে, তারা চাইছে বাংলাদেশ সংঘর্ষে জড়াক। কিন্তু বাংলাদেশকে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। সংঘর্ষের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ইস্যুকে সামনে আনতে চাইছে মিয়ানমার। কিন্তু সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে এই সংকটের সমাধান হবে না। সংকট আরও বাড়বে। বাংলাদেশকে শত্রু বানাতে উঠে-পড়ে লেগেছে। এ কারণেই আমাদের মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ভালো। প্রচুর ব্যবসা হচ্ছে। গণহত্যাকারী একটি দেশের সঙ্গে তো বাংলাদেশকে তুলনা করা যায় না। মিয়ানমারের মতো একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্ব সম্পর্ক রাখে কেমন করে, সেটাই ভাবনার।
এ কারণেই আমি বলছি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে এটি আলোচনায় নিয়ে আসতে হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও বিশেষভাবে বলে আসা দরকার প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে।
পাশাপাশি মিয়ানমারের বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বার বার গোলা নিক্ষেপ নিয়মিত ঘটনায় পরিণত করার বিষয়টিকে একপ্রকার ফাঁদ মনে করছেন বিশ্লেষকরা৷
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, উদ্দেশ্যমূলকভাবে সীমান্তে সংঘাত বাধাতে চাইছে মিয়ানমার৷ এর মাধ্যমে দেশটিতে থাকা বাকি ছয় লাখ রোহিঙ্গাকেও বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, ‘‘আসলে মিয়ানমার এক ধনের ফাঁদ পেতেছে৷ তারা সীমান্তে যুদ্ধাবস্থা তৈরি করতে চাইছে৷ সংঘাত তৈরি করতে চাইছে৷ সেটা করতে পারলে তাদের ক্যাম্পে এবং সেখানে নিয়ন্ত্রণে থাকা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়া সহজ হবে৷’’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান অবশ্য মনে করেন, এই পরিস্থিতিতে নতুন করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের আশঙ্কা তেমন নেই৷
‘‘কারণ সেখানে যে রোহিঙ্গারা এখনও আছে তাদের সংখ্যা নগণ্য৷ তারাও আবার নিরাপত্তা বাহিনীর নজরদারিতে আছে৷ তারা সহসা বেরিয়ে এসে অন্য জায়গার যাওয়ার সম্ভাবনা আমি আপাতত দেখছি না।”
এসডব্লিউ/এসএস/১৫১৫
আপনার মতামত জানানঃ