ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে আজ নয়াদিল্লি পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ সোমবার (৫ সেপ্টেম্বর) সকালে প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ভিভিআইপি চার্টার্ড ফ্লাইট হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে রওনা হয়।
বিমানটি সোমবার দুপুরে নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছে। যেখানে তাকে অভ্যর্থনা জানান ভারতের রেল ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী দর্শনা বিক্রম এবং ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মুহাম্মদ ইমরান। এই সফরকে ঘিরে আবারও সেই পুরনো আলোচনাই ফিরে আসছে। আর সেটা হলো, বেশি সুযোগো সুবিধা দিয়ে, বাংলাদেশ কি সচেতনভাবে কম পাচ্ছে ভারত থেকে।
আর আমরা ভারতকে বেশি দিচ্ছি আর পাচ্ছি কম, এমন একটা ধারণা যে বেশ জোরালোভাবে চালু আছে, সে কথারই প্রতিধ্বনি শোনা গেল সাবেক রাষ্ট্রদূত ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট এম হুমায়ূন কবীরের কথায়। অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব জোরদারের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও ভারত ‘সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (সেপা)’ সইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং সে লক্ষ্যে দুই দেশ চুক্তি শুরুর বিষয়ে আলোচনা করতে চায় বলে যে খবর পাওয়া যাচ্ছে, সে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘চুক্তিটিতে দুই পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণ করে, যাতে সুষম হয় এবং পরস্পরের জন্য সুফল বয়ে আনে, সেদিকে মনোযোগ দেওয়া বাঞ্ছনীয়। আমরা ভারতকে বেশি দিচ্ছি আর পাচ্ছি কম, এমন একটা ধারণা প্রচলিত আছে। কাজেই এই চুক্তি যদি একপক্ষীয় হয়, তবে এটি টেকসই হবে না।’
বাংলাদেশ বেশি দিচ্ছে আর পাচ্ছে কম ধারণা তৈরির পেছনে যেসব পরিসংখ্যান রয়েছে, তার একটা ছবি উঠে এসেছে বাণিজ্যবিষয়ক দৈনিক বণিক বার্তায়। ‘বৃহৎ শক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ভারসাম্য জটিল রূপ নিচ্ছে’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এখন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারত—এ তিন দেশেরই সফট পাওয়ারের (বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতা) প্রভাব দিন দিন বাড়লেও বাণিজ্য ও বিনিয়োগ খাতে বিশ্বের বৃহত্তম দুই অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ওপরেই সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব উদ্ধৃত করে পত্রিকাটি বলছে, দেশে যুক্তরাষ্ট্রের পুঞ্জীভূত এফডিআইয়ের (প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ) পরিমাণ এখন ৪৩৯ কোটি ডলারের বেশি। এদিক থেকে চীনের অবস্থান পঞ্চম এবং তার এফডিআইয়ের পরিমাণ প্রায় ১৪৪ কোটি ডলার। আর ভারতের অবস্থান দশম ও ভারতীয় এফডিআইয়ের পরিমাণ ৭৬ কোটি ডলারের কিছু বেশি।
বাণিজ্যেও এ তিন দেশের প্রাধান্য দৃশ্যমান। বাংলাদেশের মোট পণ্য আমদানির প্রায় অর্ধেকই আসে দেশ তিনটি থেকে, যার উৎস হিসেবে সবার ওপরে চীন। চীন থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট ১ হাজার ২৯২ কোটি ৫২ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় উৎস ভারত থেকে একই অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ৮৫৯ কোটি ডলারের বেশি পণ্য। পণ্য আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান একেবারেই নগণ্য, যার পরিমাণ একই সময়ে ছিল ২২৬ কোটি ৮২ লাখ ডলারের কিছু বেশি। কিন্তু রপ্তানিতে চিত্রটা একেবারেই উল্টো। বাংলাদেশি পণ্যের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৬৯৭ কোটি ডলারের বেশি। একই সময়ে ভারতে পণ্য গেছে প্রায় ১২৮ কোটি ডলার আর চীনে গেছে মাত্র ৬৮ কোটি ডলারের সামান্য বেশি।
একসময় ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাণিজ্যঘাটতির বিষয়টি বড় অস্বস্তির কারণ থাকলেও আমাদের আমদানি চাহিদার ব্যাপকতা ও রপ্তানি পণ্যের সীমাবদ্ধতার বাস্তবতায় বিষয়টি আর বড় সমস্যা হিসেবে গণ্য করা হয় না। কিন্তু অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভারত সরকারের অনুদার নীতির কারণে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়।
যখন দেশে পেঁয়াজের অভাব হয় তখন দেখা যায়, ভারত তার রপ্তানি নিষিদ্ধ করছে। চাল ও গমের ক্ষেত্রেও একই নীতির পুনরাবৃত্তি দেখা গেছে। প্রতিবেশীর প্রতি সহানুভূতির এই ঘাটতি কতটা প্রকট রূপ নেয়, তার আরেকটি দৃষ্টান্ত করোনা মহামারির সময়েও দেখা গেছে। আগাম টাকা দিয়েও বাংলাদেশ চুক্তিমতো টিকা পায়নি। বিপদের সময়ে বিকল্প উৎস সন্ধান করাটাই এখন বাংলাদেশের করণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতোই ভারতের বিনিয়োগের বেশির ভাগই অবকাঠামো খাতে। তবে ভারতের অগ্রাধিকার মূলত যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে, যার সুফল পাচ্ছে তারাই। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহন এখন কম খরচে ও স্বল্পতম সময়ে সম্ভব হচ্ছে। এখন এ সুবিধা আরও সম্প্রসারণে বেশ কিছু প্রকল্প আলোচনায় আছে।
বিপরীতে বাংলাদেশি পণ্য ও মানুষের নেপাল কিংবা ভুটানে যাওয়ার সুবিধা এখনো অবাধ হয়নি। জ্বালানি খাতেও কিছু বিনিয়োগ এসেছে, কিন্তু রামপাল প্রকল্পের পরিবেশগত ক্ষতির বোঝাটা বাংলাদেশকেই বইতে হবে। কোনো বিরোধিতা ও উদ্বেগ বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। জ্বালানি খাতে সহযোগিতার ক্ষেত্রে প্রতিবেশীর ওপর নির্ভরতা বাড়ানোয় নেপালের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথাও এ ক্ষেত্রে স্মরণ রাখা জরুরি।
সুসম্পর্কের সাফল্য হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে স্থল ও সামুদ্রিক সীমান্তের বিরোধ নিষ্পত্তির কথা প্রায়ই বলা হয়। স্থলসীমান্তের বিরোধ যে চার দশক ধরে অনিষ্পন্ন ছিল, তার দায় বাংলাদেশের নয়। কেননা, বাংলাদেশ বহু আগেই সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন করেছিল। আর সমুদ্রসীমা চিহ্নিত করার কাজটি হয়েছে আন্তর্জাতিক সালিসে। সবচেয়ে উদ্বেগ ও হতাশার বিষয় হচ্ছে, স্থলসীমান্তের বিরোধ নিষ্পত্তি হলেও সীমান্তে বেসামরিক বাংলাদেশিদের হত্যা বন্ধ হয়নি এবং ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্তাব্যক্তিদের বক্তব্যে এখনো এসব হত্যার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা অব্যাহত।
নিহত বাংলাদেশিদের চোরাচালানি হিসেবে অভিহিত করে তাদের বিনা বিচারে হত্যার নীতি বন্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্বের আন্তরিকতাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। অথচ সাম্প্রতিক খবর হচ্ছে, ভারতের প্রভাবশালী রাজনীতিক ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের লোকজনের বিরুদ্ধেই চোরাচালানির একাধিক মামলার এখন তদন্ত চলছে।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে আর যে বিষয়টিকে ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে বর্ণনা করা হয়, তা হলো গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি। যদিও চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ তার পানির হিস্যা ঠিকঠাক কখনো পেয়েছে, এমন দাবি কোনো পক্ষই করে না। আরও অর্ধশতাধিক অভিন্ন নদীর পানিবণ্টনের চুক্তির বিষয়ে আলোচনা ও সহযোগিতাও ঝুলে আছে। ১৯৭২ সালে গঠিত যৌথ নদী কমিশনের ৩৮তম বৈঠক হয়েছে ঠিক এক যুগ পর দিল্লিতে গত ২৫ আগস্ট। অগ্রগতি বিবেচনা করলে বৈঠকের জন্য ১২ বছরের জড়তা কাটানোই বিরাট।
কুশিয়ারার পানিবণ্টনের বিষয়েও একটি সমঝোতা হয়েছে, চূড়ান্ত হয়েছে ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুম শহরের খাওয়ার পানির সমস্যা মেটাতে পানি প্রত্যাহারের স্থানও। বন্যাসতর্কীকরণ ও নদীর পানি দূষণের মতো বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা হয়েছে। তবে গঙ্গার পানি বাংলাদেশ যতটা পায়, তার সর্বোচ্চ ব্যবহারের বিষয়ে একটি সমীক্ষা পরিচালনায় সম্মত হওয়ার বিষয়টি অনেক বিশেষজ্ঞকে অবাক করেছে। ভাটির দেশে চুইয়ে আসা পানির ব্যবহার সম্পর্কে প্রতিবেশীর ভূমিকা কী, তা বোঝা মুশকিল।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৩০
আপনার মতামত জানানঃ