ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে দিল্লির উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে একেবারে শেষ মুহূর্তে ভারতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী দল থেকে বাদ পড়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর থেকে শেষ মুহুর্তে ছিটকে গেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলা হলেও, বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বাদ পড়ার কারণ, সম্প্রতি সময়ে তার বিভিন্ন মন্তব্যে আওয়ামী লীগের বিব্রত হওয়ার বিষয়টি।
আজ সোমবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের সফরে দিল্লির উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন। সকাল ১০টায় ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বাকী সফরসঙ্গীদের নিয়ে বিমান বাংলাদেশের একটি বিশেষ ফ্লাইটে রওনা হন প্রধানমন্ত্রী।
এখানে উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন। সেখানেও তিনি বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে তিনি ভারত সফর করছেন। এছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, নিয়ম অনুযায়ী দেশের সরকার প্রধান যখন কোনো রাষ্ট্রীয় সফরে যান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্যই তার সঙ্গে সফরসঙ্গী হন।
কী বলছেন কর্মকর্তারা?
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বিভিন্ন সময় অযাচিত মন্তব্য করে oসমালোচনার জন্ম দিয়েছেন। তার এসব অতিকথনে সবশেষ মাত্রা যুক্ত করেছে ‘আমি ভারতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে’ মন্তব্যটি। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের এক মাসেরও কম সময় আগে চট্টগ্রামে জন্মাষ্টমী উৎসবের অনুষ্ঠানে তাঁর এই মন্তব্য সবাইকে চমকে দেয়।
বিশেষ করে, দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠকের আগে এই বক্তব্য কর্মকর্তাদের অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। এরই জেরে আজ প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাদ গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ঢাকা ও দিল্লিতে কর্মরত বাংলাদেশের একাধিক কর্মকর্তা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারতে না যাওয়ার বিষয়টি কাছে আজ সকালে নিশ্চিত করেন, তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেন ভারত সফর করছেন না, তা নিয়ে তাঁরা কোনো মন্তব্য করেননি।
কূটনৈতিক সূত্র বলছে, গতকাল রোববার গভীর রাতে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত না যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়। আজ সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে বিমানের বিশেষ ফ্লাইট ঢাকা ছাড়ার আগে দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো এ সম্পর্কে অবগত হয়।
বিব্রত আওয়ামী লীগ
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের একের পর এক মন্তব্যে বিব্রত এবং সমালোচিত হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নেতারাও এই মন্ত্রীর কথাবার্তায় রীতিমতো ক্ষুব্ধ। তারা মনে করছেন, আব্দুল মোমেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বশীল আচরণ করছেন না।
কিছুদিন আগে ‘বেহেশতে’ থাকা নিয়ে বক্তব্যের জন্য সমালোচনার মুখে পড়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, ‘কথা বলায় সতর্ক থাকতে দলের কাছ থেকে বার্তা পেয়েছেন। ভবিষ্যতে কথা বলার সময় সাবধান হবেন।’ অথচ সতর্কবার্তা পাওয়ার চারদিন পার না হতে নতুন করে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেন ড. মোমেন। চট্টগ্রামের একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘ভারতকে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এসব মন্তব্য এরইমধ্যে ‘টক অব দ্যা কান্ট্রি’তে পরিণত হয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে এখনও চলছে মন্ত্রীর মন্তব্যের তুমুল সমালোচনা। এতে পিছিয়ে নেই রাজনীতিবিদরা। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এসব বিতর্কিত মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করছেন বিরোধীরা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন মন্তব্য নিয়ে বিরক্ত খোদ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, ‘দায়িত্বশীল পদে থেকে বেফাঁস মন্তব্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এমন মন্তব্যের মাধ্যমে মন্ত্রী শুধু নিজেকে ছোটই করেননি, দেশকেও ছোট করেছেন। আর দেশে সরকার টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব দেশের মানুষের, অন্য দেশের হতে যাবে কেন।’
সাবেক কূটনীতিকরাও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, ‘মন্ত্রীর এমন বক্তব্য দেশের জন্য এবং দলের জন্য মর্যাদাহানিকর। তাই মন্ত্রীর বক্তব্য খতিয়ে দেখার পাশাপাশি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এর ব্যাখ্যা দিতে হবে।’
নাম প্রকাশ না করা শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যৈষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘ওনাকে (মোমেন) বারবার বার্তা দেওয়া হয়, যেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা না বলেন। কিন্তু এরপরও তিনি (মোমেন) বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করেই যাচ্ছেন। বুঝে নাকি না বুঝে বলেন, সেটাই তো বুঝতে পারছি না। দায়িত্বশীল পদে থেকে উনি শুধু দেশকে নয়, মন্ত্রণালয়কেও ছোট করছেন।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুনশি ফায়েজ আহমেদ বলেন, ‘এটা গোপনে বা প্রকাশ্যে কোনোভাবেই বলা উচিত না। এটা কেন উনি বলতে যাবেন। আমাদের সরকারকে কি ভারত টিকিয়ে রাখছে? আমাদের সরকার টিকিয়ে রেখেছে আমাদের দেশের মানুষ। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজেই তো বলেন, মানুষ যখন চাইবে না, থাকব না; এটাতো উনি বিভিন্ন সময়ে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমার কোনো চাওয়া পাওয়া নাই, আমার একমাত্র উদ্দেশ্য কীভাবে মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন করা যায়। তার জন্য বাহিরের কাউকে টিকিয়ে রাখতে বলতে যেতে হবে কেন?’
চীনে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা এ কূটনীতিক বলেন, আর এ রকম যদি প্রয়োজন পড়ে তাহলে কেউ এ রকম হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে সেটা বলে না কি? ওনার মন্তব্য আমাদের রাষ্ট্রের জন্য যেমন মর্যাদাহানিকর তেমনি দলের (আওয়ামী লীগ) জন্যও মর্যাদাহানিকর। এটা উনি কেন বলেছেন, সেটা নিয়ে দেখার বিষয় আছে। এ রকম করে তো বলা উচিত না। এভাবে কথা বলে উনি নিজে তো ছোট হচ্ছেনই, সঙ্গে সঙ্গে দেশসহ সবাইকে ছোট করেছেন। এ রকম বলার কোনো মানে হয় না। এমন মন্তব্যের জন্য ওনাকে দায়িত্ব নিতে হবে।’
উল্লেখ্য, ১৮ আগস্ট সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম শহরের জে এম সেন হলে জন্মাষ্টমী উৎসবের অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, সেটি করতে ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছে। তিনি বলেন, আমি ভারতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে।
চট্টগ্রামে জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্য নিয়ে ১৯ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গি পাড়ায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে। সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ভারতকে অনুরোধ করার ব্যাখ্যায় ড. মোমেন বলেন, আমি বলেছি, আমরা চাই শেখ হাসিনার স্থিতিশীলতা থাকুক। এই ব্যাপারে আপনারা (ভারত) সাহায্য করলে আমরা খুব খুশি হব।
এর আগে, গত ১২ আগস্ট সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ বিষয়ক এক মতবিনিময় সভা শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, বৈশ্বিক মন্দায় অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ ভালো আছে। দেশের মানুষ ‘বেহেশতে’ আছে।
মন্ত্রীর এমন বক্তব্যে দেশজুড়ে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হয়। এর দুই দিনের মাথায় গত ১৪ আগস্ট রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান মিশেল ব্যাশেলের সঙ্গে বৈঠকের পর ড. মোমেন গণমাধ্যমকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, আমি তো ট্রু সেন্সে ‘বেহেশত’ বলিনি। কথার কথা। কিন্তু আপনারা সবাই আমারে খায়া ফেললেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫১৫
আপনার মতামত জানানঃ