দেশে ব্যাংক খাতের পাশাপাশি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) খাতেও খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চলতি বছরের গত জুন শেষে দেশে ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা। এরমধ্যে কেবল ১০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৭৫ শতাংশ।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন নানা অনিয়মের কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে ঋণ খেলাপি বাড়ছে। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণ জালিয়াতির ঘটনাও দেখা গেছে। এসব অনিয়মের ফলে আমানতের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও টাকা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে কিছু প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের গত জুন শেষে দেশে ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ স্থিতি ছিল ৬৯ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। এরমধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৫ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা, যা মোট স্থিতির ২২ দশমিক ৯৯ শতাংশ।
প্রসঙ্গত, গত জুন শেষে ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ খেলাপির পরিমাণ ১১ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা, যা এই খাতের মোট ঋণ খেলাপির ৭৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এরমধ্যে শুধু ৩ প্রতিষ্ঠানের খেলাপি দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। যা এই খাতের মোট খেলাপির ৩৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
ঋণখেলাপী ১০ প্রতিষ্ঠান
সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক (এপ্রিল-জুন) শেষে সবচেয়ে বেশি ঋণ খেলাপি ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল)। প্রতিষ্ঠানটির ঋণ খেলাপির পরিমাণ ৩ হাজার ১৫১ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
এরপর রয়েছে ফাস (এফএএস) ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট। প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭২০ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ১ হাজার ২৪৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ঋণ খেলাপি নিয়ে তিনে রয়েছে উত্তরা ফাইন্যান্স লিমিটেড।
এছাড়া প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেডের ঋণ খেলাপির পরিমাণ ৯১৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা, ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ইডকল) ৯১৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা, ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টম্যান্ট লিমিটেডের ৮৮১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, আভিভা ফাইন্যান্স লিমিটেডের (সাবেক রিলায়েন্স ফাইন্যান্স) ৮৫৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা, ফার্স্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টম্যান্ট লিমিটেডের ৮২০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফসি) ৭৫৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা এবং ফনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ঋণ খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৩৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের দুর্নীতির কারণে ঋণ খেলাপি হচ্ছে উল্লেখ করে অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, ঋণ খেলাপিদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা রকম সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে না আসলে ঋণ খেলাপির পরিমাণ বাড়তে থাকবে। এটি আর্থিক খাতের জন্য অনেক ঝুঁকিপূর্ণ।
নেই কোন আইনানুগ ব্যবস্থা
এছাড়া ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সেটি নেয়া হয় না। এতে খেলাপির পরিমাণ বাড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুন শেষে এনবিএফআইগুলোর মোট বিতরণ করা ৬৯ হাজার ৩১৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা ঋণের বিপরীতে খেলাপি হয়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ৫৪ দশমিক ২৯ শতাংশ।
২০২১ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা। এছাড়া চলতি বছরের মার্চ শেষে এনবিএফআইগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ২৩২ কোটি ৮ লাখ টাকা। আর ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ৬৮ হাজার ৯৭৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এদিকে ব্যাংক খাতেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুন মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। ৩ মাস আগে মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা।
সে হিসাবে ৩ মাসে খেলাপি বেড়েছে ১১ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। ২০২১ সালের জুন প্রান্তিক শেষে খেলাপি ছিল ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৬ হাজার ৫২ কোটি টাকা। দেশের ইতিহাসে এটি সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে কোনো গ্রাহক ঋণ পরিশোধ না করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে তাকে খেলাপি করা হয়নি। ফলে আদায় তলানিতে নামলেও খেলাপি ঋণ কম ছিল। ২০২১ সালে বিশেষ সুবিধার ছাড় কিছুটা কমায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর খেলাপি ঋণ গিয়ে ঠেকে ১ লাখ ৩ হাজার ২৩ কোটি টাকায়। এখন কিছু সুবিধা তুলে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু তারপরও গ্রাহক ঋণ পরিশোধ করছে না। বিশেষ করে বড় ঋণগ্রহীতারা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৪০
আপনার মতামত জানানঃ