নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার কান্দিরবাজার থেকে ২০২১ সালের জুন মাসে অপহরণ করা হয় তরুন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রায়হান নোমানকে। তার সঙ্গে আরো দুইজনকেও নেয়া হয়। তিনি মাদ্রাসার পড়াশুনা শেষ করে ওড়না বিক্রির দোকান দিয়েছিলেন। তার বাবা সারোয়ার হোসেনও ওই বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।
পাঁচ মাস আগে সারোয়ার হোসেন জানতে পারেন তার ছেলে জেলে আছে। তাকে আটকের দুই মাস পর ২০২১ সালের আগস্ট মাসে সূত্রাপুর থানায় হামলার একটি মামলায় তাকে আটক দেখানো হয়েছে। এখনো তিনি কারাগারে আছেন।
বাবা সারোয়ার হোসেন জানান, পাঁচ মাস আগে তিনি তার ছেলের কারাগারে থাকার খবর পান। চার মাস আগে আদালতে আনা হলে তিনি তার সঙ্গে দেখা করেন। ওই সময় তিনি তারা ছেলের কাছ থেকে জানতে পারেন তাকে কোথায় কীভাবে রাখা হয়েছিলো।
তিনি বলেন, আমার ছেলে আমাকে জানিয়েছে তাদের তিন জনকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। তাদের কোথায় রেখেছে সেই জায়গার কথা তারা বলতে পারে না। তাদের প্রথম এক জায়গায় তিন মাস চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিলো একটি অন্ধকার রুমে। হাত পা বাঁধেনি। রুমের মধ্যেই তাদের খাবার দিয়েছে। তাদের মোট চার-পাঁচজনকে এক রুমে রাখা হয়। ওখান থেকে আরো কয়েক জায়গায় নিয়ে তাদের একইভাবে রাখা হয়। নির্যাতনও করা হয়।
বাংলাদেশে গুম বা নিখোঁজ হওয়ার পর যারা ফিরে আসেন তারা প্রায় কেউই আর সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন না। দুই একজন যারা কথা বলেন তারাও থাকেন ভয়ের মধ্যে তবে তাদের কয়েকজনের সঙ্গে মানবাধিকার সংগঠন গুলো কথা বলেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের(আসক) সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার কর্মী নূর খান জানান, বিভিন্ন সময়ে ফিরে আসা অন্তত ৫০ জনের সঙ্গে চেষ্টা করে চার-পাঁচ জনের সঙ্গে তারা কথা বলতে পেরেছেন। অনেকেই ট্রমায় ভুগছেন। তাদের নিখোঁজের কথা জানতে চাইলে তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।
যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে তাদের উদ্ধৃত করে নূর খান বলেন, তাদের কাউকে বাড়ি থেকে আবার কাউকে অন্য জায়গা থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে চোখ বেঁধে। তাদের রাখা হয়েছে বন্দিশালার মত জায়গায়। ঢাকা শহর বা আশাপাশে এরকম বন্দিশালা আছে।
তাদের কয়েকজনকে এক রুমে রাখা হতো। সেই সব রুমে আলো বাতাস প্রবেশের সুযোগ তেমন নেই। তারপরও তাদের সেখানেও চোখ বেঁধেই রাখা হয়েছে। তারা অনুমান করে বলেছে তাদের কোনো ভবনে রাখা হয়েছিলো। ওইসব ভবনে একাধিক ঘর আছে। কোনো কোনো ঘরে একজনকেও রাখা হয়। তাদের ওইসব ভবনে পাহারায় লোক আছে।”
তিনি বলেন, বাথরুমে নেওয় বা খাবার দেওয়ার সময় বন্দিদের বাঁধা চোখ কখনো কখনো আলগা হয়ে যায় । তারা হঠাৎ আলো দেখতে পায় । সেখান থেতে তারা তাদের অবস্থান ও পরিবেশ অনুমান করে।
তার কথা, তারা জানিয়েছে তাদের ধরার সাথে সাথে তাদের চোখ বেঁধে গাড়িতে তোলা হয়। এরপর বিভিন্ন রাস্তায় ঘোরানো হয়। গাড়িগুলো কালো কাঁচের থাকে। এর পর সেখানে নেয়া হয় সেখানে কখনো ভারি লোহার গেট খোলার শব্দ শোনা যায়। আর সে সব ঘরে নেয়া হয় সেখানে লোহার শিক দেয়া থাকে অথবা টিন কাঠও দেয়া থাকে। তাদের নির্যাতনও করা হয়।
অন্যদিকে যারা গুম হয়েছে তাদের পরিবার বা গুম হওয়ার সময় প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে বার বার কথা বলেছেন নূর খান। তিনি বলেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি যারা নিয়ে যায় তারা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, শক্ত সমর্থ, বয়সে তরুণ, চুল ছোট। তাদের সঙ্গে অধিকাংশ সময়েই ছোট আগ্নেয়াস্ত্র থাকে এবং তাদের প্রশিক্ষিত মনে হয়।
নূর খান মনে করেন, যারা ফিরে এসেছেন এবং গুম হওয়াদের পরিবার যেসব তথ্য দিচ্ছে তাতে অনেকটাই স্পষ্ট যে কারা এই গুমের সঙ্গে জড়িত। রাষ্ট্র চাইলেই তাদের পরিচয় তদন্ত করে বের করতে পারে। রাষ্ট্র চায় না বলেই আসলে গুমের সঙ্গে জড়িতদের জানা যাচ্ছে না।
এদিকে, বিশ্ব গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষ্যে মঙ্গলবার শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে সমবেত হয়েছিলেন গুম হওয়াদের পরিবারের সদস্যরা। “মায়ের ডাক” একটি সংগঠনের ব্যানারে প্রতিবছরই তারা সমবেত হন। যারা গুম হয়েছেন তাদের স্ত্রী সন্তানরাও সেখানে ছিলেন।
এই সংগঠনটির প্রধান সানজিদা ইসলাম আঁখি জানান, আমরা আমাদের স্বজনদের জন্য এখনো অপেক্ষা করছি। তাদের ফিরয়ে দেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই।
সানজিদার ভাই বিএনপি নেতা সাজিদুল ইসলাম শিমুলকে ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বসুন্ধরা এলাকায় তার এক আত্মীয়ের বাসা থেকে নিয়ে যায় অজ্ঞাত ব্যক্তিরা। তিনি জানান, আমার ভাইকে তো র্যাব নিয়ে গেছে। তার সঙ্গে আরো পাঁচজনকে নিয়ে যাওয়া হয়।
তিনি বলেন, কোনো মামলা নেয়নি থানা । তারা র্যাবের নাম বাদ দিয়ে নিখোঁজের মামলা করতে বলে। আমরা আদালতেও গিয়েছিলাম কিন্তু কোনো ফল পাইনি। আমরা যত জায়গার যাওয়ার গিয়েছি কিন্তু আমার ভাইকে পাইনি।
তিনি জানান, তবে গত জানুয়ারি মাসের দিকে পুলিশ আমার শাহীনবাগের বাসায় এসেছিলো। আমার কাছ থেকে পুলিশ তাদের লেখা কাগজে স্বাক্ষর নিতে চেয়েছিলো। আমি দেইনি। তবে অনেকের পরিবারের কাছ থেকে নিয়েছে। আমরা পরে সংবাদ সম্মেলন করে এটা জনিয়েছি।
নূর খানের ধারণা, যাদের হত্যার উদ্দেশ্যে নেয়া হয় তাদের দুই-এক সপ্তাহের মধ্যেই হত্যা করা হয়। আর যাদের হত্যার উদ্দেশ্য থাকে না তাদের তিন থেকে ছয় মাস আটকে রেখে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু তখন তারা আর স্বাভাবিক থাকে না।
২০১৬ সালের মার্চে অপহৃত হওয়া এরকম এক ব্যক্তি নিখোঁজ হওয়ার দুই সপ্তাহ পর ছাড়া পান। ছাড়া পাওয়ার পর তিনি এই প্রতিবেদককে কীভাবে তারা চোখ বেঁধে অপহরণ করা হয়েছিলো, কীভাবে তাকে রাখা হয়েছিলো সে কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু মঙ্গলবার তাকে আবার ফোন করলে তিনি বলেন, আমাকে কেউ অপহরণ করেনি। আমি স্বেচ্ছায় তাদের কাছে গিয়েছিলাম।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই এই সাত মাসে দুইটি গুম বা নিখোঁজের ঘটনা নজরে এসেছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) নজরে। কিন্তু গত ১৫ বছরে ৬১৪ জন নিখোঁজের তথ্য আছে তাদের কাছে। যাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছে।
তাদের মধ্যে গত বছরের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার দেখানো হয়ে ৯৪ জনকে। ফেরত এসেছেন ৫৭ জন। বাকিদের এখনো কোনো খোঁজ মেলেনি।
এসডব্লিউ/এসএস/২১৪৫
আপনার মতামত জানানঃ