রাজনীতিবিদদের কাছে দেশের মানুষ কত অসহায়? তারা নিজেদের স্বার্থে যেসব সিদ্ধান্ত নেবেন, আমাদের তা মেনে নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এটা কি কোনো সভ্য দেশে আছে? তারা পোস্টার ছাপাবেন আর লিখবেন ‘প্রচারে: দেশের জনগণ’। অথচ এ দেশের অধিকাংশ মানুষ সচেতন নয় বলে তাদের ব্যবহার করেন আমাদের দেশের রাজনীতিবিদেরা।
সমাজের অসচেতন ও অশিক্ষিত লোকজনকে নিয়ে মিটিং-মিছিল, ভাঙচুর ও বাস-ট্রাকে পেট্রলবোমা মেরে মানুষ হত্যা করা সহজ বলে এই পথ বেছে নিয়েছে রাজনীতিবিদেরা। আমাদের দেশের লোকজন রাজনীতিবিদদের কাছে জিম্মি। আমাদের অধিকার ক্ষমতার কাছে অসহায়।
পুলিশ কি কোনো অপরাধীকে ধরে বা রিমান্ডে নিয়ে মারতে পারে? মেয়েরা কি বাবার বাড়ির সম্পদের আইন স্বীকৃত অংশটুকু ঝামেলা ছাড়াই বুঝে পায়? এমন কিছু প্রশ্নে বাংলাদেশের মানুষের নাগরিক হিসেবে দীনতা ফুটে উঠবে।
নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ কতটা অধিকার ভোগ করছে! কতটা বিচার পাওয়ার অধিকার এদেশের মানুষের আছে৷ স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করার ক্ষেত্রে মানুষ কতটা সংকোচহীন। এসব প্রশ্নের উত্তর একেবারে স্বস্তিদায়ক নয়। অধিকাংশ মানুষই মত প্রকাশ করতে চায় না, কিন্তু যারা মত প্রকাশ করতে চায় তাদের মনের মধ্যে অনেক সংকোচ থাকে৷ যেমন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের কারণে মানুষের মনের মধ্যে এক ধরনের সংকোচ ও শঙ্কা দেখা দেয়৷ কী কথা বলতে, কী কথা বলব তারপর আমি বিপদে পড়ব৷
এখানে প্রশ্ন ওঠে, অধিকার কি ক্ষমতার কাছে অসহায়। উত্তর, অবশ্যই৷ অধিকার মূলত ক্ষমতার সঙ্গেই সম্পর্কিত৷ যার ক্ষমতা আছে সে অন্যের অধিকার কেড়ে নেয় বা অন্যের অধিকারের উপর আধিপত্য বিস্তার করে৷ এটা তো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যেই আছে৷ মানুষের অধিকারগুলো তো রাষ্ট্রেরই দেওয়ার কথা৷ রাষ্ট্র যে এগুলো দিচ্ছে না, সেটা আমাদের জন্য দুঃখজনক৷
আমরা দেখি যে রাজনৈতিক দলগুলো বিরোধীদলে যখন থাকে তখন তারা মানুষের অধিকারের কথা বলে৷ কিন্তু তারাই আবার সরকারে গেলে সেই অধিকার হরণের চেষ্টা করে। কেউ যখন বিরোধী দল থেকে সরকারে যায় তখন তারা ভুলে যায় আগে কি বলেছিল৷
গোটা ব্যবস্থাটাই পুঁজিবাদী আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা৷ রাষ্ট্র এই অধিকারগুলো দেবে না৷ ফলে যারা সরকারে যাচ্ছে তারা ওই ব্যবস্থার অধিনেই চলে যাচ্ছে৷ তখন তারা ওই ব্যবস্থাটাকে রক্ষা করতে চায়৷ সেজন্য অল্প লোক সুবিধা পায়, অধিকাংশ লোক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়৷ এটা আমাদের রাষ্ট্রীয় সামাজিক ব্যবস্থার বিধান৷ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় কে এল আর গেল তাতে অধিকারের সুরক্ষা হয় না৷ ফলে সরকার বদলে অধিকাংশ মানুষের জীবনে কোন পরিবর্তন ঘটে না৷
এই ধরুন চা শ্রমিকদের কথাই বলি৷ তারা দৈনিক ১২০ টাকা মজুরি পায়৷ তাদের কী একটু ভালভাবে জীবন-যাপন করার অধিকার নেই? এটা তো অমানবিক৷ একটা লোক ১২০ টাকা দিয়ে একটা দিন কীভাবে পার করবে? যারা একটু অবস্থা সম্পন্ন তাদের তো নাস্তা খেতেই ১২০ টাকা লাগে৷ তাহলে কি দাঁড়াল ব্যাপারটা৷ তারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, দূরে থাকে৷ ফলে তাদের খবর আমরা মধ্যবিত্তরা জানি না, চিন্তাও করি না৷ এটা তো ভয়াবহ পরিস্থিতি৷
মূলত মানুষের অধিকার হরণ না করে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় না। আমাদের যে ব্যবস্থা সেটাও বৈষম্যমূলক৷ এখানে কিছু লোক সুবিধা পাবে এবং অধিকাংশ লোক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে৷ সেজন্য দেখা যায়, ক্ষমতায় যারা যায় তারা সুবিধাপ্রাপ্ত৷ সেই সুবিধাগুলো তারা ভোগ করতে চায়৷ সেজন্যই অধিকাংশ মানুষ বঞ্চিত হয়৷ এটা কোন ব্যক্তিগত ব্যাপার না বা আমাদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে না৷ গোটা ব্যবস্থাটাই এমন৷ সুযোগ প্রাপ্ত ও সুযোগ বঞ্চিতদের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছেই৷
সরকারি প্রতিষ্ঠান বা আদালতে মানুষ কতটা অধিকার ভোগ করতে পারে? সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তো আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান৷ এটা পুরানো আমলাতন্ত্র৷ এটা বদলায়নি৷ বরং আরও কঠিন হয়েছে৷ এখানে মানবিক আচরণ পাওয়া যায় না৷ আদালতে যে বিচারের জন্য কেউ যাবে সেখানে যেতে অনেক টাকা লাগে৷ আদালতে গেলে যে বিচার পাওয়া যাবে তার নিশ্চয়তা তো পরের ব্যাপারে৷ আদালতে যাওয়াটাই তো অনেক ব্যয়বহুল৷ সেখানে গেলে যে ঝামেলায় পড়বে সে কারণে অনেকেই বলে বিচার চাই না৷ বিচার কার কাছে চাইব৷ পরিস্থিতি এখন এমন৷
তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের অধিকার সচেতন করতে কিছুটা হলেও ভূমিকা পালন করছে। তবে সেখানেও আছে সমস্যা। মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নানা ইস্যুতে তারাই সোচ্চার হয়৷ কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সীমাবদ্ধতা হল, তারা সংস্কারমূলক৷ তারা সংস্কার চায় কিন্তু ব্যবস্থাটা এমন নেই৷ এই ব্যবস্থার একটা মৌলিক পরিবর্তন দরকার৷ সেটা তারা বলে না৷
তারা এই ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেই এর মধ্যে কতটা বাড়ানো যায় সেই চেষ্টা করে৷ তারা মনে করে, এই ব্যবস্থাটা টিকিয়ে রাখার জন্য সংস্কার দরকার৷ একটা গণতান্ত্রিক সমাজ এবং রাষ্ট্র গঠন করা দরকার৷ যে রাষ্ট্রে মানুষে মানুষে অধিকারে কোন বৈষম্য থাকবে না৷ যেখানে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে৷ যেখানে জনপ্রতিনিধিদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্টিত হবে৷ সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিদের৷ ওই জায়গাটাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের যাবার কথা না বা তারা যেতেও পারে না৷
এখানে নারীদের কথা আলাদা করে বলা উচিত। দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি নারী হলেও অধিকার বিষয়ক সচেতনতায় বহু জায়গায় এখনো পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ, এমনটাই মনে করেন দেশের অন্যতম শীর্ষ নারী অধিকার-মানবাধিকার সংগঠক খুশি কবীর৷
তার মতে, বিভিন্ন পদ-পদবিতে নারীরা এখন আগের চেয়ে অনেক এগিয়ে এসেছে৷ নির্যাতন থেকে বাঁচতে ট্রিপল নাইনের মতো ব্যবস্থাপনা নিয়ে সচেতনতা গ্রাম পর্যায়েও ছড়িয়ে গেছে৷ কিন্তু এরপরও নারী অধিকার নিয়ে আদর্শ অবস্থায় পৌঁছাতে পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘপথ৷
তিনি বলেন, ‘‘নারীর ঘরের বাইরে কাজ করা উচিত বলে মনে করেন, তাদের অনেকেও ঘরের কাজ শুধুনারীর কাজ বলে মনে করেন৷’’
নির্যাতন হলে নারীকে দোষারোপ, আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধা সৃষ্টি, নারী শ্রমিকদের কম মজুরি দেয়া, পারিবারিক আইনে নারীকে সমান না দেখার মতো বিষয়গুলো এখনো সমাজে প্রবলভাবে রয়েছে বলে মনে করেন তিনি৷
তিনি বলেন, ‘‘বারিক আইনের কোনোটিতে উত্তরাধিকার সম্পদে নারীকে সমান অধিকার দেয়া হয়নি আবার কোনোটিতে সম্পদে সমান অধিকার দিলেও ডিভোর্সের ক্ষেত্রে সমান অধিকার দেয়া হয়নি৷”
এ সব আইনের পরিবর্তে একটি অভিন্ন অসাম্প্রদায়িক পারিবারিক আইন তৈরির দাবি করেন তিনি৷ তবে নারীকে পূর্ণ অধিকার দিতে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে বলেও উল্লেখ করেন খুশি কবীর৷
তিনি বলেন, ‘‘আইনে থাকলেও অনেক সময় সমাজ সম্পত্তি দিতে চায় না৷ দেখা যায়, সম্পত্তি নিতে চাইলে মা তখন তার সাথে কথা বলে না৷ সচেতনতার অনেক দূর৷ অফিসে আদালতে যৌন হয়রানিতে কী করা উচিত সেটা সে জানে না৷’’
মানবাধিকার বিষয়ক সচেতনতা সম্পর্কে দেশের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, ‘‘একটা দেশের মানুষকে সচেতন করতে যে পরিবেশ দরকার হয়, বাংলাদেশে সেই পরিবেশ অনুপস্থিত৷’’
‘‘অর্থাৎ নাগরিক অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা, জীবনের স্বাধীনতা-এর কোনোটাই সচেতন হয়ে প্রয়োগ করার স্কোপ ব্যক্তির নেই৷ যতক্ষণ না সেই পরিবেশটা আপনি তাকে দিচ্ছেন৷ অর্থাৎ, রাষ্ট্র সেই পরিবেশটা যদি নিশ্চিত না করে বা সেই রকম আবহ তৈরি না করে, তাহলে মানুষ তার যে অধিকার, সেটা জানার পরও সেটা প্রয়োগ করার জন্য বা চাওয়ার জন্য ক্ষমতা অর্জন করতে পারে না৷’’
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে এই জায়গাটিতেই আমরা সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় রয়েছি৷ সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় রয়েছি৷’’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘মোটা দাগে যেটা করতে হবে, মানবাধিকারের বিষয়ে সচেতন করতে চাইলে তাকে সেটা জানালেন, সে সচেতন হলো৷ সেটার প্রায়োগিক দিকটার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা রাষ্ট্রের ব্যবস্থা৷’’
‘‘আজ যদি বিচার ব্যবস্থার কথা বলি, সেখানে প্রচণ্ড দুর্বলতা রয়ে গেছে৷ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, সে তার কাজ করার চেষ্টা করছে বা সে যা যা করছে, সেটার কোনোটিই কিন্তু আর মানবাধিকারকে সুরক্ষা দেয়ার মতো নেই৷’’
‘ফলে মানুষকে আপনি যতই সচেতন করেন না কেন, মানুষ হয়ত অধিকার সম্পর্কে জানছে, মানুষ হয়ত সচেতন হচ্ছে, কিন্তু সেটা প্রয়োগ করা বা বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে একটা দুর্বলতা বা বাধা রয়ে গেছে৷ যে বাধা অতিক্রম করা না গেলে কোনোটিই ফলপ্রসু হবে না৷’’
এসডব্লিউ/এসএস/১২৩৮
আপনার মতামত জানানঃ