রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য অস্থিতিশীল হয়ে ওঠেছে। যার কারণে ইতিমধ্যে চাপের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। লোকসান এড়াতে দেশে সকল জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়েছে সরকার।
হঠাৎ করে এই জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ। এর প্রভাব পড়েছে সব ধরনের দ্রব্যমূল্যে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে কম মূল্যে তেল রপ্তানি করতে চেয়েছে রাশিয়া।
তবে সম্ভাব্য বাণিজ্যিক ঝুঁকি এড়াতে রাশিয়া থেকে সরাসরি নয়, বরং তৃতীয় দেশের মাধ্যমে তেল কেনার বিষয়ে আগ্রহী বাংলাদেশ। আজ রোববার (২১ আগস্ট) বার্তা সংস্থা ইউএনবি এ তথ্য জানিয়েছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়া থেকে তেল কেনার বিষয়ে প্রতিবেশী ভারতকেই তৃতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পছন্দ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থাটিকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ভারত বর্তমানে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করছে। ভারতের আসাম রাজ্যের নুমালিগড় তেল শোধনাগার থেকে পরিশোধিত তেল কেনার বিষয়ে দিল্লির সঙ্গে ঢাকার দীর্ঘ মেয়াদি চুক্তি আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি থাকে তাহলে এমন ব্যবসা করা সম্ভব।’ তার মতে, কম টাকায় রুশ তেল কেনার সম্ভাব্য ঝুঁকি এভাবে এড়ানো যেতে পারে।
মস্কোভিত্তিক রুশ প্রতিষ্ঠান রুশনেফট পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম বিশেষ করে ডিজেল কম দামে বাংলাদেশের কাছে বিক্রির দেওয়ার প্রস্তাব দিলে এর সম্ভাব্যতা নিয়ে সম্প্রতি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা হয়।
রুশ প্রতিষ্ঠানটি রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে প্রতি ব্যারেল পেট্রোলিয়াম ৫৯ ডলারে বিক্রির প্রস্তাব দেয়। বর্তমানে এর বাজারমূল্য ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলার। প্রতিবেদন অনুসারে, রুশ প্রতিষ্ঠানটি পরিবহন খরচসহ পেট্রোলিয়াম এই মূল্যে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।
তবে জ্বালানি মন্ত্রণালয় রুশ প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাব সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি। জ্বালানিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বাংলাদেশকে সমর্থন জানাচ্ছে ইইউ
তবে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করার বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর বলছেন অনেকে। উপমহাদেশে ভারতের অবস্থান সুদৃঢ়। অন্যদিকে চীনের কর্তৃত্ব অনেকটাজুড়ে। কাজেই বিশ্বের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারত বা চীন যা করতে পারবে চাইলেই বাংলাদেশের পক্ষে তা করে দেখানো সম্ভব নয়। সেটা করতে যাওয়াটাও বোকামি হবে বলে মনে করেন অনেকে।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেন, রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল কেনা আমাদের জন্য বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হবে কি হবে না তার চেয়ে জরুরি হচ্ছে আদশর্গত দিক থেকে কোনোভাবেই বাংলাদেশের উচিত হবে না এই তেল নেওয়া। অথর্নীতি বিচারে, একদিকে এই তেল নিয়ে আমাদের যে লাভ হতে পারে তারচেয়ে ক্ষতির আশঙ্কা বেশি।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, তেল নেওয়ার কারণে ইউরোপের দেশগুলো বা যুক্তরাষ্ট্র যদি আমাদের গার্মেন্ট শিল্পে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তা আমরা সামাল দিতে পারবো না। আমাদের অথর্নীতি দাঁড়িয়ে আছে গার্মেন্টসের ওপর। তাই ক্রেতাদের খেপিয়ে তেল কেনা মোটেই লাভজনক হবে না।
যদিও গত জুলাই মাসে রাশিয়া থেকে বাংলাদেশ জ্বালানি তেল আমদানি করলে আপত্তি নেই বলে জানিয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের সফররত প্রতিনিধিরা। তখন তারা বলেন, এতে সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে না।
ওই সময় তিন দিনের সফরে ঢাকায় এসেছিলেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিটির ৬ সদস্যের প্রতিনিধি। তখন কূটনৈতিক প্রতিবেদকদের সংগঠন-ডিকাবের অনুষ্ঠানে যোগ দেন তারা। এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিনিধি দলটি জানায়, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা এখনই বন্ধ করা উচিত। কারণ এ যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে, প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলছে, জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে বাংলাদেশ। ইইউ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিটির সদস্য ম্যাক্সিমিলান কারাহ বলেন, শান্তিপূর্ণ অবস্থান রক্ষায় আমাদেরকে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হয়েছে। যুদ্ধ বন্ধ করতে এটা সহায়ক হবে বলে মনে করে ইইউ।
তবে জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নিজের মত সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে ইইউর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের কোন প্রভাব পড়বে না বলে আমরা আশ্বস্ত করছি
ভারতীয়দের যুক্তি
রাশিয়া ভারতকে তেল দিচ্ছে অনেকটাই কম দামে। আর ভারত যেহেতু বিশ্বের তৃতীয় বড় তেল আমদানিকারী দেশ, তাই রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল কিনে বিদেশি মুদ্রার বিপুল সাশ্রয় করছে দিল্লি। রিফিনিটিভ আইকনের রিপোর্ট উদ্ধৃত করে রয়টার্স জানাচ্ছে, ভারত গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩৪ মিলিয়ন ব্যারেল তেল আমদানি করেছে রাশিয়া থেকে। তার মধ্যে ২৪ মিলিয়ন ব্যারেল এসেছে গত একমাসে। ফলে ভারত তেল কেনা বাড়াচ্ছে, কমাচ্ছে না।
কিন্তু ভারতের পক্ষে যা সম্ভব, সেটা কী বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব? আউটলুক পত্রিকার কূটনৈতিক সম্পাদক প্রণয় শর্মা মনে করেন, ভারত ও বাংলাদেশের পরিস্থিতি আলাদা। ভারত যে চাপ উপেক্ষা করে রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তায় তেল কিনতে পারে, সেই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ নেই।
তিনি বলেন, ”ভারত ও অ্যামেরিকা একে অপরের উপর নির্ভরশীল। অর্থনীতি, সামরিক শক্তি, প্রযুক্তি সবদিক থেকে দেখতে গেলে অ্যামেরিকা এখনো এক নম্বর দেশ। তাই সকলেই অ্যামেরিকার সঙ্গে সুস্পর্ক রাখতে চায়। অ্যামেরিকা নিজের স্বার্থে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চায়।”
প্রণয় মনে করেন, অ্যামেরিকা ভারতকে বেশি গুরুত্ব দেয় দুইটি কারণে। অ্যামেরিকার কাছে চীন হলো প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। অ্যামেরিকা মনে করে, ইন্দো-প্যাসিফিকে ভারত বড় ভূমিকা নিতে পারে। দ্বিতীয়ত, ভারতের বাজার। ভারতীয়রাও এখন অ্যামেরিকায় বিনিয়োগ করছে। প্রণয় জানিয়েছেন, ”ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক। এখনো ৫০ শতাংশ সামরিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম রাশিয়া থেকে আসে। ভারতের পক্ষে রাশিয়াকে ছেড়ে দেয়া, নিষেধাজ্ঞায় সায় দেয়া সম্ভব নয়। অ্যামেরিকাও প্রকাশ্যে না বললেও বুঝতে পেরেছে, ভারতের নীতির পিছনে যুক্তি আছে।
কিন্তু বাংলাদেশের কাছে এই সুবিধা আছে কি? প্রণয়ের মতে, ”বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক এখন ভালো। আগে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সঙ্গে হিলারি ক্লিন্টনের সম্পর্ক ভালো ছিল না। তখন দুই দেশের তিক্ততা বাড়ে। কিন্তু এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই।” তার দাবি, ”বাংলাদেশ গত ১০ বছরে যেভাবে স্থায়িত্ব বজায় রাখতে পেরেছে, যেভাবে তাদের আর্থিক উন্নতি হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। এখন অ্যামেরিকাও চাইবে বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভালো থাকুক। চীনের প্রভাব কম হোক। কিন্তু তারা ভারত সম্পর্কে যে নীতি নেবে, তা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নেবে না।”
যোজনা কমিশনের সাবেক উচ্চপদস্থ আমলা অমিতাভ রায় মনে করেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটা সমস্যা আছে। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ”ঢাকার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভালো, আবার তারা অ্যামেরিকাকে চটাতে চায় না। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিকেও তারা খুশি রাখতে চায়। সেজন্যই তারা ভারতের কাছ থেকে পরামর্শ চায়।”
অমিতাভের মনে হচ্ছে, ”বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে ভালো সমাধান এবং যেটা তারা চাইতেও পারে, সেটা হলো, ভারতই রাশিয়া থেকে একটু বেশি তেল কিনে বাংলাদেশকে দিক। তাহলে সবদিক রক্ষা করতে পারে বাংলাদেশ। ভারত বড় দেশ ও সুবিধাজনক অবস্থানে আছে বলে, তারা চাপ উপেক্ষা করতে পারে। বাংলাদেশের পক্ষে তা সম্ভব হবে না।”
প্রণয় মনে করেন, ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ এই বিষয়ে পরামর্শ নিতে পারে, আইডিয়া নিতে পারে, অ্যামেরিকাকে বোঝাতে পারে, রাশিয়ার তেল তাদেরও প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তব হলো, অ্যামেরিকার যতটা ভারতকে প্রয়োজন, ততটা বাংলাদেশকে প্রয়োজন নয়।
তার বক্তব্য, ”এখন বাংলাদেশের দরকার কূটনৈতিক দক্ষতা। তারা অ্যামেরিকাকে কতটা বোঝাতে পারে, তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করবে।”
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৫৫
আপনার মতামত জানানঃ