জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট চার দিনের সফরে আগামীকাল রোববার ঢাকায় আসছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও সরকারের অন্তত চারজন মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বৈঠকের কথা রয়েছে। এ ছাড়া নেতৃস্থানীয় মানবাধিকার কর্মীদের সঙ্গেও কথা বলবেন তিনি।
এ সফরে প্রধানত বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং এ প্রসঙ্গে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে কথা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার মিশেল ব্যাচেলেটের সফরকে বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করার একটি সুযোগ হিসেবে দেখছে সরকার।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, কোনও দেশই সব বিষয়ে নিখুঁত নয়। প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ যেমন আছে, তেমনি মানবাধিকার রক্ষায় অনেক পদক্ষেপও নেওয়া হয়। মানবাধিকার বিষয়ে বাংলাদেশের বিষয়টি হাই-কমিশনারে সফরে ব্যাখ্যা করা হবে। এছাড়া আসন্ন মানবাধিকার কাউন্সিলের নির্বাচনে অংশ নেবে বাংলাদেশ এবং এজন্য বাড়তি কিছু করারও তাগিদ রয়েছে সরকারের।
জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সদর দফতর এক বার্তায় জানিয়েছে, চার দিনের সফরে রবিবার (১৪ আগস্ট) ঢাকায় পৌঁছাবেন মিশেল ব্যাচেলেট। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি দেখতে বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণেই তার এই সফর। জাতিসংঘের কোনও মানবাধিকার প্রধানের এটিই হবে প্রথম কোনও সরকারি সফর।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘এই প্রথমবারের কোনও মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার বাংলাদেশ সফর করছেন। আমরা তাকে স্বাগত জানাই। এ সফরে আমরাও সুযোগ পাবো আমাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করার এবং আমরা কী করেছি সেটি বলার। একদিকে যেমন কী কী হয়নি সেটির অভিযোগ তিনি জানবেন, আবার অন্যদিকে অনেক কিছু হয়েছে সেটিও বলার সুযোগ তৈরি হয়।’
দেশে মানবাধিকার লংঘন বিষয়ে অনেক ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায় উল্লেখ করে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘এর কিছু অভিযোগ খতিয়ে দেখার মতো, আবার অনেকগুলোর কোনও ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। পত্রিকায় যা প্রকাশ হয়, সেখানে যে সবকিছু বলা হয় সেটাও নয়। অনেক সময় হয়তো, অভিযোগকারীর কথা বেশি বলা হয়।’ কিন্তু পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে সেটির খবর প্রকাশ হয় না বলেও দাবি করেন তিনি।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘অনেক সময়ে সংবাদপত্রে কোনও অভিযোগ প্রকাশ হওয়ার পরে অনুসন্ধান করে তেমন কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু এটি যেহেতু ছাপা হয়েছে সেটি অভিযোগের তালিকার মধ্যে ঢুকে যায়। অনেক এনজিও যেমন অধিকার এমন সব খবর দেয় যেগুলোর বাস্তবে কোনও ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। ২০১৩ সালে হেফাজতের ইসলামের সমাবেশ নিয়ে এধরনের ভিত্তিহীন কিছু রিপোর্ট হয়েছিল।’
গঠনমূলক আলোচনার প্রত্যাশা
সরকার সবার সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনা করতে চায় এবং এর মাধ্যমে সমাজ ব্যবস্থা তথা রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলকর বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে চায়।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘সরকারের সংশ্লিষ্ঠ এজেন্সি, জাতীয় মানবাধিকার সংস্থা, এনজিও, একাডেমিয়া, সুশীল সমাজ, গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্যরা এই ধরনের সফরে আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারে। এরফলে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে তিনি বিষয়টি সরাসরি শুনতে পাবেন।’
তিনি বলেন, ‘এরফলে বাস্তব অবস্থা বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র বা আইন মন্ত্রণালয় নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করার সুযোগ পায়। এধরনের গঠনমূলক আলোচনা যে কোনও সমাজ ব্যবস্থা বা রাষ্ট্রের জন্য একটি ভালো একটি বিষয়।’
মানবাধিকার কাউন্সিল নির্বাচন
মানবাধিকার কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে প্রায় প্রতিটি কার্য নির্বাহী কমিটিতে বাংলাদেশ সদস্য ছিল। ২০২৩-২৪ মেয়াদের কার্য নির্বাহী কমিটিতে নির্বাচন করছে বাংলাদেশ। এ কারণে এই সফরকে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।
মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘আমরা মানবাধিকার কাউন্সিলের নির্বাহী সদস্য হওয়ার জন্য প্রার্থিতা দিয়েছি এবং সেইজন্য আমাদের বাড়তি কিছু করার প্রয়োজন আছে। আমাদের দিক থেকে সেজন্য আগ্রহ আছে।’
জেনেভাতে বিভিন্ন র্যাপোর্টিয়ার আছে এবং হাই কমিশনার নিজে বিভিন্ন দেশে সফর করে সরেজমিনে মানবাধিকার পরিস্থিতি দেখেন এবং কোনও ধরনের ত্রুটি থাকলে সংশ্লিষ্ট দেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেন বলেও জানান পররাষ্ট্র সচিব।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ অনেক সময় তাদের আমন্ত্রণ জানায় অথবা তারা আসার আগ্রহ ব্যক্ত করলে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু কভিডের জন্য ওই সফর কিছুদিন বন্ধ ছিল। সম্ভবত হাই কমিশনার হিসেবে এটি তার শেষ সফর। এরপর মানবাধিকার কাউন্সিলের যে সেশন আছে সেখানে তিনি সম্ভবত তিনি দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন বলেও জানান তিনি।
রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করবেন হাই কমিশনার
হাই কমিশনার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করবেন। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, তিনি কক্সবাজারে যাবেন, সেখানকার সুবিধা এবং অসুবিধাগুলো দেখবেন। রোহিঙ্গা শিবিরে আমাদের পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব সবটুকু আমরা করছি। তারপরও অনেক অভিযোগ আছে, সেগুলো তিনি দেখবেন।
তিনি বলেন, জাতিসংঘের র্যাপোরিটিয়ার বা কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না মিয়ানমার। আর এ কারণে মিয়ানমারের যে গ্রহণযোগ্যতা… সেটি নিশ্চয় আমরা চাইবো না।
মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ
আইন-শৃংখলা বাহিনীর মানবাধিকার লংঘন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অপব্যবহারসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক যে ইস্যুগুলো আছে যেমন ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন সেটি নিয়ে অনেক ভুল ধারণা আছে এবং অভিযোগ আছে। সেগুলো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বা আইন বা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হবে; সেখানে আমরা বোঝানোর চেষ্টা করবো যে, কোনও আইনই শতভাগ সঠিক নয়। এর বাস্তবায়নের সময়ে অনেক ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটে। এজন্য আমরা কী ব্যবস্থা গ্রহণ করছি, সেটি বলা যাবে।’
সব অধিকারের বিষয়ে বাংলাদেশ শ্রদ্ধাশীল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের সংবিধানে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের কথা যেমন বলা আছে; তেমনি মতা প্রকাশের এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথাও বলা হয়েছে।’
এদিকে, ২০২১ সালকে মানবাধিকার ‘লঙ্ঘনের’ বছর হিসেবে উল্লেখ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র। সংগঠনটি জানায়, মানবাধিকার পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যা সহ্যক্ষমতার বাইরে। এটিকে বর্বরতাও বলা যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৮০ জন। তাঁদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর হাতে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছেন ৫১ জন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় নিহত হয়েছেন আটজন। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনে ছয়জন, হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে একজন এবং একজন গ্রেপ্তারের পর নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন।
আসকের তথ্য বলছে, গত বছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের শিকার হয়েছেন ৭ জন। তাঁদের মধ্যে পরে ৬ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হলেও ১ জন এখনো নিখোঁজ। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরকে ঘিরে হেফাজতে ইসলামের ডাকা বিক্ষোভ ঘিরে সহিংসতায় অন্তত ১৪ জন নিহত হন। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে ১৬ জনসহ মোট ১৮ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া নির্বাচন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক সহিংসতায় গত বছর ২৭০ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন প্রায় ১৮ হাজার মানুষ। আর গত বছর অন্তত ২০ বার দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৪৪ ধারা জারির ঘটনা ঘটেছে।
সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি
বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থাটি প্রতিবছরই মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি প্রতিবেদন দেয়। ২০১৩ সাল থেকে হিন্দুসহ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর হামলার ঘটনাগুলোও তারা প্রতিবেদনে আলাদাভাবে দিয়ে আসছে।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে আসক নয় বছরে হিন্দুদের উপর সাড়ে ৩ হাজারের বেশি হামলার তথ্য দিলেও প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশি বলে দাবি করেন বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত।
দুর্গাপূজার মধ্যে গত বছর ১৩ অক্টোবর কুমিল্লার একটি মণ্ডপে কুরআন অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে বেশ কয়েকটি মণ্ডপ ও স্থাপনা ভাংচুর হয়। তার জের ধরে তিন দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৭০টি পূজামণ্ডপে হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে বলে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ হিসাব দেয়।
আসকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আট বছর নয় মাসে হিন্দুদের উপর ৩ হাজার ৬৭৯টি হামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৫৯টি বাড়িঘর ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা। এই সময়ে হিন্দুদের ৪৪২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর ও আগুন দেওয়া হয়েছে।
প্রতিমা, পূজামণ্ডপ, মন্দিরে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৬৭৮টি। এসব হামলায় আহত হয়েছে ৮৬২ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। নিহত হয়েছে ১১ জন। এর বাইরেও ২০১৪ সালে দুজন হিন্দু নারী ধর্ষণের শিকার হন। শ্লীলতাহানি করা হয় আরও চারজনের।
এছাড়া ২০১৬, ২০১৭ ও ২০২০ সালে ১০টি হিন্দু পরিবারকে জমি ও বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে দখলের অভিযোগ ওঠে। আসকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত নয় বছরে হিন্দুদের উপর সবচেয়ে বেশি হামলা হয়েছে ২০১৪ সালে। ওই বছরের ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচন হয়েছিল। এর পরবর্তী সহিংসতার শিকার হন হিন্দুরা। ৭৬১টি হিন্দু বাড়ি-ঘর, ১৯৩টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ২৪৭টি মন্দির-মণ্ডপে হামলা হয় ওই বছর। তখন নিহত হন একজন।
সবচেয়ে কম হামলা হয়েছে ২০২০ সালে। মহামারীর মধ্যে গত বছর ১১টি বাড়ি ও ৩টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার তথ্য রয়েছে আসকের প্রতিবেদনে। তবে মন্দিরে হামলা হয়েছে ৬৭টি।
তথ্য ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, এই সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হিন্দু খুন হয়েছে ২০১৬ সালে, মোট সাতজন। এসব হত্যাকাণ্ডের অনেকগুলো ‘জঙ্গি হামলা’ বলে পরে জানিয়েছে পুলিশ।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৫৮
আপনার মতামত জানানঃ