লন্ডন পুলিশের বিরুদ্ধে নানা সময়ে যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের অভিযোগ এসেছে। এবার আতঙ্ক করার মতো খবর হলো, লন্ডন পুলিশ দুই বছরের ব্যবধানে ৬০০টির বেশি শিশুর দেহ তল্লাশি করেছে, যাদের বেশির ভাগই কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেশিশু।
আজ সোমবার(০৮ আগস্ট) প্রকাশিত নতুন এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি।
ইংল্যান্ডে শিশুদের নিয়ে কাজ করা কমিশনার র্যাচেল ডি সুজা বলেছেন, মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছ থেকে এই পরিসংখ্যান পাওয়ার পর তিনি ‘বেশ হতবাক’ হয়েছেন।
ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় পুলিশ বাহিনীকে গত মার্চে ‘চাইল্ড কিউ’-এর মামলার জন্য ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়েছিল। তখন চার পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চরম অসদাচরণের জন্য তদন্ত শুরু হয়।
২০২০ সালে ১৫ বছর বয়সী এক স্কুলছাত্রীকে গাঁজা বহন করছে এমন অভিযোগে তল্লাশি করেন নারী পুলিশ কর্মকর্তা। ওই ছাত্রীর তখন মাসিক চলছিল বলে পুলিশ সদস্যদের অবহিত করা হলেও তারা তল্লাশি বন্ধ করেননি। পরে দেখা গেল তাকে ভুলভাবে সন্দেহ করা হয়েছিল।
ডি সুজা জানান, ওই স্কুলছাত্রীকে ‘উপযুক্ত প্রাপ্তবয়স্ক’র উপস্থিতি ছাড়াই তল্লাশি করা হয়েছিল। এমন ঘটনায় ২৩ শতাংশ ক্ষেত্রেই প্রাপ্তবয়স্ক কোনো ব্যক্তির উপস্থিতি ছিল না।
ডি সুজা আরও জানান, ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৬৫০ জন অপ্রাপ্ত বয়স্ককে পুলিশ কর্মকর্তারা তল্লাশি করেছেন। যাদের ৯৫ শতাংশের বেশি ছেলেশিশু ছিল। ৬৫০টি শিশুর মধ্যে ৫৮ শতাংশ ছিল কৃষ্ণাঙ্গ। এই সংখ্যা বছরের পর বছর ব্যাপক হারে বেড়েছে।
ডি সুজা আরও বলেন, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশু প্রতিবছর এই অনুপ্রবেশকারী এবং আঘাতমূলক অনুশীলনের শিকার হচ্ছে।
ডি সুজা বলেন, তিনি জাতিগত ভারসাম্যহীনতায় ‘অত্যন্ত উদ্বিগ্ন’। মেট্রোপলিটন পুলিশের মধ্যে ‘শিশু সুরক্ষার আশপাশে পদ্ধতিগত সমস্যার’ বড় অংশ হতে পারে চাইল্ড কিউ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় লন্ডন পুলিশ কর্মকর্তাদের কয়েকটি ঘটনা বেশ সমালোচনা তৈরি করে। গত বছর সারাহ এভারার্ডকে অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে কূটনৈতিক সুরক্ষা স্কোয়াডের এক সদস্যকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থার সংকট তৈরি হওয়ায় ক্রেসিডা ডিক গত ফেব্রুয়ারিতে মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
ডি সুজার অনুসন্ধানের প্রতিক্রিয়ায়, লন্ডন পুলিশ বলছে, তারা ইতিমধ্যে ‘অনুপ্রবেশকারী অনুসন্ধানের বিষয়ে শিশুদের সঙ্গে যথাযথভাবে এবং সম্মানের সঙ্গে আচরণ করা নিশ্চিত করতে’ পরিবর্তন শুরু করেছে। তারা স্বীকার করেছে, কিছু শিশু নিজেরাই গ্যাংস্টার এবং মাদক অপরাধীদের দ্বারা ‘শোষণের ঝুঁকিপূর্ণ শিকার’ হতে পারে।
উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশু প্রতিবছর এই অনুপ্রবেশকারী এবং আঘাতমূলক অনুশীলনের শিকার হচ্ছে।
লন্ডনের মেয়র সাদিক খান চাইল্ড কিউ কেস এবং অন্যান্য ঘটনা নিয়ে মেট্রোপলিটন পুলিশের সমালোচনা করেছেন। সাদিক খানের এক মুখপাত্র বলেন, এটি ‘গভীরভাবে উদ্বেগজনক’ যে একজন প্রাপ্তবয়স্কের উপস্থিতি ছাড়াই এতগুলো শিশুর দেহ তল্লাশি চলেছে।
নারীর প্রতি সহিংসতা সভ্য জগৎ ব্যবস্থার প্রতি কঠোর কশাঘাতস্বরূপ। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, নারীকে পদে পদে হেয় বা অবমাননা করা, সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখা, নারীর অর্জন বেহাত করা, জোর খাটানো, গৃহস্থালিতে সম্পৃক্ত নারীর কাজের অবমূল্যায়ন, অ্যাসিড দিয়ে মুখ ঝলসে দেওয়া, যৌন ও অন্যান্য নির্যাতন-নিপীড়নের পাশাপাশি নারী তথা মানব সভ্যতায় সহিংসতার সবচেয়ে মারাত্মক ও ভয়ংকর রূপ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে ধর্ষণ।
লন্ডনে যারা ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে পুলিশের কাছে যান, তাদের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ ভুক্তভোগী এক মাসের মধ্যে নিজেদের অভিযোগ থেকে সরে আসেন। দুই বছরে সেই হার তিন গুণ বেড়ে যায় বলে সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে।
লন্ডনের ইনডিপেনডেন্ট ভিকটিমস কমিশনার ক্লাইরে ওয়াক্সম্যান গবেষণায় সতর্কতা প্রকাশ করেছেন যে, ভুক্তভোগীদের মধ্যে বিশেষ করে নারীরা ন্যায়বিচার পাওয়ার চেষ্টা থেকে অপমানিত হয়ে নিরুৎসাহিত হচ্ছে।
যারা পুলিশের কাছে ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেছেন, তাদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ অভিযোগ থেকে সরে এসেছেন। দুই বছর আগে লন্ডনে করা শেষ জরিপের ফলের তুলনায় এই হার সাত শতাংশ বেশি।
ব্রিটেনের মেট্র্রোপলিটন পুলিশ নারীদের নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত ৬৫০ জন পুলিশ অফিসার নিয়োগের পরিকল্পনা করেছে। যারা কিনা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করবে। কিন্তু যেখানে পুলিশ অফিসার দ্বারা একজন নারী ধর্ষণ ও হত্যা হয়, সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ অফিসার নিয়োগেও অনিরাপত্তায় ভুগছেন ব্রিটেনের নারীরা।
ব্রিটেনে সারাহ এভারার্ড নামের একজন নারীকে ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে এক পুলিশ অফিসারকে দোষী স্বাবস্ত করা হয়েছে। মূলত লকডাউন চলাকালে আইন লঙ্ঘনের মিথ্যা অজুহাতে তরুণী এভারার্ডকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছে দেশটির পুলিশের কর্মকর্তা ওয়েন কুজেন্স। যাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এই পুলিশ অফিসার তরুণীর বিরুদ্ধে ভুয়া ওয়ারেন্ট দেখিয়ে ওই তরুণীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে।
সেই তদন্ত চলাকালীনই পুলিশের বহু অফিসারের বিরুদ্ধে এমন অপরাধের ঘটনা এক এক করে উঠে আসতে শুরু করে। তদন্ত এগোতেই এই ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত পুলিশ অফিসারদের যে সংখ্যাটা উঠে আসে, তা দেখে আঁতকে ওঠেন তদন্তকারীরা।
অভিযোগ, ধর্ষণ, যৌন হেনস্থা, শিশু নিগ্রহের ঘটনায় জড়িত প্রায় দু’হাজার পুলিশ। গত চার বছর ধরে তারা এই ধরনের অপরাধ করছেন বলে অভিযোগ। এই ঘটনা ইতিমধ্যেই শোরগোল ফেলে দিয়েছে গোটা ব্রিটেনে।
ফ্রিডম অব ইনফর্মেশন-এর তথ্য বলছে, ২০১৭ থেকে গত চার বছরের মধ্যে ৩৭০টি যৌন হেনস্থা, ১০০টি ধর্ষণ এবং ১৮টি শিশু নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে যার সবক’টির সঙ্গেই জড়িত পুলিশকর্মীরা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, নারীকে ‘মানুষ’ নয়; ‘ভোগের সামগ্রী’ হিসাবে ভাবার পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন করতে হবে। প্রথমেই প্রয়োজন ধর্ষণ-সংস্কৃতিকে উসকে দেয়, প্রশ্রয় দেয়; তেমন সমাজকে ধর্ষণবিরোধী, ধর্ষণ প্রতিরোধী সমাজে রূপান্তর করা।
এর জন্য গল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপনে নারীকে ‘যৌন পণ্য’ হিসাবে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। নারীকে ‘মানুষ’ হিসাবে ভাবার সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে। অন্যদিকে সমাজে যেসব মিথ ও ভ্রান্ত ধারণা ধর্ষণকে প্রশ্রয় দেয়, তেমন মিথগুলোকে ভেঙে দিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩১
আপনার মতামত জানানঃ