অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, তার ধাক্কা লেগেছে শেয়ারবাজারেও। অর্থনীতিতে যে চাপ তৈরি হয়েছে, তাতে শঙ্কিত শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরাও। এ কারণে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির অনেক বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজার থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। বাজারে দেখা দিয়েছে মন্দাভাব। অস্থিরতার ধাক্কায় গত সপ্তাহে বাজার থেকে বিনিয়োগকারীদের সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা উধাও হয়ে গেছে।
দেখা যাচ্ছে, ঈদুল আজহার ছুটির পর গত সাত কার্যদিবসে একটানা দরপতন চলছে পুঁজিবাজারে। বলা হচ্ছে, অর্থনীতিতে যে চাপ তৈরি হয়েছে, তাতে শঙ্কিত শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরাও। এ কারণে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির অনেক বিনিয়োগকারী এখন শেয়ারবাজার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। এর ফলে প্রতিদিনই সূচকের পতন হচ্ছে।
বাজারে দেখা দিয়েছে মন্দাভাব। বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ঈদুল আজহার ছুটির পর গত সাত কার্যদিবসে একটানা দরপতনে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ২২৮ পয়েন্ট কমেছে। এতে ডিএসইএক্স সূচকটি নেমে এসেছে ৬ হাজার ১৩৯ পয়েন্টে। আর ছয় কার্যদিবসের ব্যবধানে লেনদেন ১২৪ কোটি টাকা কমে নেমে এসেছে ৬৬৫ কোটি টাকায়।
শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড বা সিডিবিএলের তথ্য অনুযায়ী, ঈদের ছুটির পর টানা পতনের মধ্যে প্রায় ছয় হাজার বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করে বিও হিসাব খালি করেছেন।
এদিকে গত ১ জুন থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত শেয়ারবাজারে ৩৩ দিন লেনদেন হয়েছে। এই ৩৩ দিনের মধ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ২০ দিনই কমেছে। বেড়েছে ১৩ দিন।
জানা গেছে, বাজারে এখন প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের বড় অংশ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। একটি অংশ টানা পতনে লোকসানে পড়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। আরেকটি অংশ সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে চুপচাপ বসে আছে।
গত সপ্তাহের বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গেলো সপ্তাহে দেশের শেয়ারবাজারে লেনদেন হওয়া পাঁচ কার্যদিবসের প্রতি কার্যদিবসেই দরপতন হয়েছে। সপ্তাহজুড়ে লেনদেনে অংশ নেওয়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমার পাশাপাশি কমেছে মূল্যসূচকও। এতে এক সপ্তাহেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার ওপরে কমে গেছে। বাজার মূলধন কমার পাশাপাশি গেলো সপ্তাহে কমেছে লেনদেনের পরিমাণ।
ঈদের পর গত সপ্তাহের আগের সপ্তাহে শেয়ারবাজারে তিন কার্যদিবস লেনদেন হয়। ওই তিন কার্যদিবসেই দরপতন হওয়ায় ডিএসইর বাজার মূলধন প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা কমে যায়।
তথ্য বলছে, গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসের লেনদেন শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ তিন হাজার ১১৯ কোটি টাকা, যা তার আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ছিল পাঁচ লাখ ১৫ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত সপ্তাহে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ১২ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। আগের সপ্তাহে ডিএসইর বাজার মূলধন কমে দুই হাজার ৮১২ কোটি টাকা। এতে দুই সপ্তাহের টানা পতনে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ১৫ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা।
এদিকে সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেওয়া মাত্র ৪৫টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ৩৩১টির। আর ১১টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
এর ফলে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স কমেছে ১৯৭ দশমিক ৯৯ পয়েন্ট। আগের সপ্তাহে সূচকটি কমেছিল ৪২ দশমিক ৪৫ পয়েন্ট । আর বাছাই করা ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক কমেছে ৭৩ দশমিক শূন্য ২ পয়েন্ট। আগের সপ্তাহে সূচকটি কমেছিল ১৯ দশমিক ৯২ পয়েন্ট।
প্রধান ও ডিএসই-৩০ মূল্যসূচকের পাশাপাশি গত সপ্তাহে ইসলামি শরিয়াহ ভিত্তিতে পরিচালিত কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই শরিয়াহ সূচকও কমেছে। গত সপ্তাহে এই সূচকটি কমেছে ৩২ দশমিক ২৭ পয়েন্ট। আগের সপ্তাহে সূচকটি কমে ১০ দশমিক ৫৪ পয়েন্ট।
বাজারের তথ্য বলছে, গত সপ্তাহের প্রতি কার্যদিবসে ডিএসইতে গড়ে লেনদেন হয়েছে ৫৫৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয় ৬৫৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কার্যদিবসে গড় লেনদেন কমেছে ১০০ কোটি এক লাখ টাকা।
এদিকে গত সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে দুই হাজার ৭৭০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে লেনদেন হয় এক হাজার ৯৬২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। সেই হিসাবে মোট লেনদেন বেড়েছে ৮০৮ কোটি ২২ লাখ টাকা। মোট লেনদেন বাড়ার কারণ গত সপ্তাহের আগের সপ্তাহে দুই কার্যদিবস কম লেনদেন হয়েছিল।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ‘আমাদের বাজার যতটা না অর্থনৈতিক কারণে আক্রান্ত, তার চেয়ে বেশি মনস্তাত্ত্বিক ও ভয়ের প্রভাব। গত কয়েক দিনে সরকার সংকট মোকাবিলায় যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে মানুষের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক ভর করেছে। যার প্রভাব এসে শেয়ারবাজারেও লাগছে।’
শেয়ারবাজারে কেন এ দরপতন তা জানতে গত কয়েক দিনে অন্তত আটটি ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁদের বেশির ভাগই জানিয়েছেন, বাজারে এখন প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের বড় অংশ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। একটি অংশ টানা পতনে লোকসানে পড়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। আরেকটি অংশ সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে চুপচাপ বসে আছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শীর্ষস্থানীয় একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মার্চেন্ট ব্যাংকের প্রধান জানান, শেয়ারবাজারে তাঁদের ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগসীমা ও বিনিয়োগের জন্য বরাদ্দ করা তহবিল রয়েছে। গত বছর সেই তহবিলের পুরোটা বাজারে বিনিয়োগ করা হয়েছিল। এরপর মুনাফাসহ বড় একটি অংশই তুলে নেওয়া হয়। বর্তমানে শেয়ারবাজারে তাদের ৫০ কোটি টাকার মতো বিনিয়োগ আছে। বাকি অর্থ ব্যাংকে স্থায়ী আমানত ও জিরো কুপন বন্ডে বিনিয়োগ করে রাখা হয়েছে। এ দুই খাতে বিনিয়োগের বিপরীতে সাড়ে ৭ শতাংশ হারে সুদ মিলছে। কিন্তু শেয়ারবাজারে এ অর্থ বিনিয়োগ করলে তাতে লোকসানের বড় ঝুঁকি রয়েছে।
কেন শেয়ারবাজারের প্রতিষ্ঠান হয়েও বাজার থেকে বিনিয়োগ তুলে নিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, বৈশ্বিক ও দেশের অর্থনীতির যে সংকট তৈরি হয়েছে, শেয়ারবাজার তার বাইরে থাকবে না। এ অবস্থায় বাজারে বিনিয়োগ করে মুনাফা তুলে নেওয়া খুব কঠিন। এ কারণে তহবিল ঝুঁকি কমাতে কিছু অর্থ নিরাপদ বিনিয়োগ পণ্যে খাটানো হয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৫০
আপনার মতামত জানানঃ