বিশ্বের যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্য বা আমদানি-রপ্তানি বেশি হয়, টাকার অংকে সেই তালিকার শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে নেই রাশিয়া বা ইউক্রেন। কিন্তু দুইটি দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের বাণিজ্য রয়েছে।
যদিও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে। কিন্তু বৈশ্বায়নের এই যুগে পৃথিবীর যেকোনো দেশের মধ্যে সংঘাতের প্রভাব অন্য দেশগুলোর ওপরেও ছড়িয়ে যায়।
ফলে হাজার কিলোমিটার দূরের এই দুই দেশের সংকট নানাভাবে প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে বাংলাদেশের নাগরিকদের ওপরেও। এই যেমন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের খবরে অস্থির হয়ে উঠেছে দেশের শেয়ারবাজার।
রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে দেশের পুঁজিবাজারে দেখা দেয়া ধসে ব্যাপকহারে ক্ষতির মুখে পড়েছে বিনিয়োগকারীরা। ভালো-মন্দ নির্বিশেষে পড়ছে শেয়ারের দর। সূচক এক বছর আগের কাছাকাছি নেমে এসেছে।
এক দিনে সাড়ে তিনশরও বেশি শেয়ারের দরপতন। লেনদেনের সাড়ে চার ঘণ্টায় সূচকের টানা পতন, লেনদেন নেমে তলানিতে। পুঁজিবাজারের টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীরা ক্ষুব্ধ, আতঙ্কিত।
এই টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ২০১০ সালের মহাধসের স্মৃতি যে ফিরেছে, সেটি পুঁজিবাজারকেন্দ্রিক নানা ফেসবুক পেজে ঢুঁ দিলেই বোঝা যায়।
২০১০ সালের মহাধসের স্মৃতি ফিরছে
গতকাল রোববার (২৭ ফেব্রুয়ারি ) প্রধান বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেনের শুরুতেই মূল্য সূচকের বড় পতন হয়েছে। ধারাবাহিক এই পতন চলতে থাকে বেলা সাড়ে ১২টা পযর্ন্ত। এরপর কিছু সময়ের জন্য সূচক ঘুরে দাঁড়ালেও সেটা স্থায়ী হয়নি। দিনশেষে ডিএসই প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১৬৩ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৬ হাজার ৬৭৬ পয়েন্টে।
অপর দুই সূচকের মধ্যে বাছাই করা ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক ৪৭ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ২ হাজার ৪৬৭ পয়েন্টে এবং শরীয়াহ সূচক ৩০ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ৪৪৫ পয়েন্টে।
আজ লেনদেনে অংশ নেয়া প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি কোম্পানির শেয়ারদর কমেছে। রোববার ডিএসইতে মোট ৩৭৯টি কোম্পানি লেনদেনে অংশ নেয়। এর মধ্যে দাম বেড়েছে ১০টির, কমেছে ৩৬৫টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৪টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিটের দাম।
সূচক ও শেয়ারদরের সঙ্গে ডিএসইতে কমেছে মোট লেনদেনের পরিমাণও। আজ বাজারটিতে লেনদেন হয় ৯১৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা। গত কার্যদিবসে ডিএসইতে লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৫০ কোটি ২৮ লাখ টাকার। সে হিসেবে আজ লেনদেন কমেছে ১৩৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।
টাকার অঙ্কে ডিএসইতে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে বেক্সিমকোর। কোম্পানিটির লেনদেন হয়েছে ৫৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের লেনদেন হয়েছে ২৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা এবং তৃতীয় অবস্থানে থাকা ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর লেনদেন হয়েছে ২৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ হামলা শুরুর দিন সূচক যত পড়েছিল, অষ্টম কর্মদিবসে সোমবার তা পড়েছে আরও বেশি। এই কয় দিনে সূচক পড়েছে ৩৮২ পয়েন্ট বা ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
হামলার দিন সূচক পড়েছিল ১০৯ পয়েন্ট। সেদিন সারা বিশ্বেই পতন হয়েছিল পুঁজিবাজারের, তবে পরের কর্মদিবসেই বিশ্বের প্রধান পুঁজিবাজারগুলো ঘুরে দাঁড়ালেও তার পরের কর্মদিবস ২৭ ফেব্রুয়ারি আরও বড় পতন দেখে দেশের পুঁজিবাজার। সেদিন সূচক পড়ে ১৬৩ পয়েন্ট।
চলতি সপ্তাহের প্রথম দিন ৫৭ পয়েন্ট সূচক পতনের স্মৃতি নিয়ে দ্বিতীয় কর্মদিবসে সকাল ১০টায় লেনদেন শুরুর পর সময় যত গড়িয়েছে, সূচক কেবল পড়েছেই। বেলা শেষে আগের দিনের চেয়ে ১৮২ পয়েন্ট কমে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স দাঁড়ায় ৬ হাজার ৪৫৬ পয়েন্ট।
যে ৩৭৯ কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের লেনদেন হয়েছে, তার মধ্যে দাম বেড়েছে কেবল ১০টির। এর মধ্যে আবার তিনটির দাম বেড়েছে এক শতাংশের কম। দর ধরে রাখতে পেরেছে ৮টি কোম্পানি, আর কমেছে ৩৬৪টির দর। এক দিনে এত বেশি কোম্পানির শেয়ারের দরপতন সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি।
পুঁজিবাজারের এই অবস্থান গত বছরের ২৯ জুলাইয়ের পর সর্বনিম্ন। সেদিন ডিএসইএক্সের অবস্থান ছিল ৬ হাজার ৪২৫ পয়েন্ট। তবে সে সময় বিনিয়োগকারীরা ছিল উৎফুল্ল। কারণ, তখন বাজারে ছিল চাঙাভাব আর প্রায় প্রতি দিনই সূচক আগের অবস্থানকে ছাড়িয়ে ২০১০ সালের মহাধসের পর সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে যায়।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকেই পুঁজিবাজারে শুরু হয় দর সংশোধন। চলতি বছরের শুরুতে সংশোধন কাটিয়ে চাঙাভাবে ফেরার আভাস দেখা যায়। তবে সেটি স্থায়ী হয়নি। জানুয়ারির শেষেই আবার পড়তে থাকে বাজার।
এর মধ্যে ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে নেগেটিভ ইক্যুইটির বিও হিসাব ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সমন্বয়ের আদেশের একটি গুজব ছড়ায়। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি জানায়, তারা এমন কোনো আদেশ দেয়নি। শেষে একটি আদেশ জারি হয়, তাতে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের কথা জানানো হয়।
সংশ্লিষ্টদের মতামত
এর মধ্যে বিএসইসির কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, গুজব ছড়িয়ে বাজারে পতন ঘটানো হয়েছে। যারা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের বিচার করা হবে। তবে ঘোষণাই সার, বাজারে আস্থা ফিরবে এমন কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
সংশোধন কাটিয়ে চলতি বছরের শুরুতে লেনদেন আবার দুই হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি চলে এলেও বাজারে ধস পরিস্থিতিতে তা অনেকটাই কমে গেছে। টানা ৭ কর্মদিবস এক হাজার কোটি টাকার কম শেয়ার হাতবদল হলো।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ডিএসই পরিচালক ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বাজারে। আরও কমতে পারে-এই ভয়ে সবাই শেয়ার বিক্রি করে দিতে চাইছে। সেই বিক্রির চাপে বাজারে বড় পতন হচ্ছে।
‘ছোট-বড় সব বিনিয়োগকারীই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। বুঝতে পারছি না যুদ্ধের ডামাডোলে বাজার শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে নামবে।’
বিক্রির চাপ কমাতে লোকসান দিয়ে শেয়ার বিক্রি না করতে বিনিয়োগকারীদের পরামর্শ দিয়েছেন শাকিল রিজভী। বলেছেন, বিক্রয়চাপ কমলেই ধীরে ধীরে আতঙ্ক কাটবে।
আরেক বাজার বিশ্লেষক ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাক আহমেদ সাদেক বলেন, ‘যুদ্ধের প্রভাব বাজারে পড়েছে ঠিক। কিন্তু এর বাইরে কোনো কারসাজি করে বাজার অস্থিতিশীল করা হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে বিএসইসিকে। যদি অন্য কোনো কারণে বাজারে অব্যাহত পতন হয়, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা দিতে হবে।’
এই বাজার বিশ্লেষক বলেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য ৫০ বছরের বাংলাদেশেও একটি সুস্থির পুঁজিবাজার পেলাম না।’
শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে তেলের দাম বেড়ে যাবে। এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলবে। সেটার প্রভাব পুঁজিবাজারে চলে আসবে। এই আশঙ্কা থেকে অনেক বিনিয়োগকারী তাদের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে। যার ফলে শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭০০
আপনার মতামত জানানঃ