ঘোষণা করা হয়েছিল দিনে একবার একঘণ্টা বিদ্যুতের লোডশেডিং করা হবে। কিন্তু বাস্তবে দেশের কোথাও কোথাও দিনে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে।
বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে প্রয়োজনীয় সরবরাহ না পাওয়ায় বাড়তি লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বেড়েছে আবাসিকে গ্যাস সঙ্কট। বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের সাথে গ্যাস সঙ্কট বেড়ে যাওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছে সাধারণ মানুষ। সামর্থ্যবানরা বিকল্প হিসেবে জেনারেটর, আইপিএস ব্যবহার করছেন। কিন্তু লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় আইপিএস দিয়েও কুলানো যাচ্ছে না। গ্রামে চার্জার বাতি, টর্চ লাইটের বেচাকেনা বেড়ে গেছে।
গতকাল বুধবার ছিল সরকারের পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের ২য় দিন। এ দিন ঢাকায় কোথাও কোথাও দুই থেকে তিন ঘণ্টা, আর রাজধানীর বাইরে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা লোডশেডিং হয়েছে। দেশের ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।
তারা সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, রাজধানীর দুটি বিতরণ কোম্পানি ডিপিডিসি ও ডেসকো গতকাল সর্বোচ্চ ৩০০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ ঘাটতি পেয়েছে। কোনো এলাকায় এক ঘণ্টা দিলেও অন্য এলাকায় একটু বেশি লোডশেডিং করতে হয়েছে তাদের। ফিডার একটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের আওতাধীন এলাকা ধরে লোডশেডিংয়ের রুটিন করা হলেও তা রাখতে পারছে না ডিপিডিসি ও ডেসকো। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে দেশের বৃহত্তর বিতরণ কোম্পানি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। অনেক এলাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হচ্ছে তাদের। এতে ঢাকার বাইরের গ্রাহকের ভোগান্তি হচ্ছে বেশি।
বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে জ্বালানি সাশ্রয়ে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের একটি হলো পরিকল্পিত এক ঘণ্টার লোডশেডিং। গতকাল দ্বিতীয় দিনেও লোডশেডিংয়ের রুটিন (সময়সূচি) মানা যায়নি ঢাকার বাইরে।
দিনের বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদনের তথ্য পরের দিন প্রকাশ করে পিডিবি। গত মঙ্গলবার সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে ১১ হাজার ৭৪২ মেগাওয়াট। গতকাল পিডিবির দিনে সর্বোচ্চ চাহিদার পূর্বাভাস ছিল ১৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। আর উৎপাদন ১২ হাজার ৫১ মেগাওয়াট। ২ হাজার ১৪৯ মেগাওয়াট ঘাটতি হতে পারে। এ ঘাটতি পূরণে গড়ে দুই ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং করা দরকার পড়ে বলে জানিয়েছেন পিডিবির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।
তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, এক ঘণ্টা লোডশেডিংয়ে ৯৭৬ মেগাওয়াট সাশ্রয় হয়। বৃষ্টি নামায় চাহিদা পূর্বাভাসের চেয়ে কমেছে। তাই লোডশেডিং কমানো গেছে।
সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে দেশের বৃহত্তর বিতরণ কোম্পানি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। অনেক এলাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হচ্ছে তাদের। এতে ঢাকার বাইরের গ্রাহকের ভোগান্তি হচ্ছে বেশি।
পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) সূত্র বলছে, রংপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের জেলাগুলোতে এবং ঢাকার আশপাশের সমিতিগুলো একটু নাজুক অবস্থায় পড়েছে। চাহিদার তুলনায় তারা সরবরাহ অনেক কম পাচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা ও উপজেলাগুলোর শহর এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ওজোপাডিকো। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন শহর এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে আছে নেসকো। আর শহর ও গ্রাম মিলে দেশের কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পিডিবি।
রংপুর বিভাগের আট জেলায় ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে। বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ প্রায় অর্ধেক থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিভাগের জেলা শহরগুলোর তুলনায় গ্রামাঞ্চলের অবস্থা আরও নাজুক। এ বিভাগে বিদ্যুতের চাহিদা ৯৫০ থেকে ১ হাজার মেগাওয়াট। গতকাল দিনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে ৫০০ মেগাওয়াট।
হাসপাতালসহ জরুরি কিছু জায়গায় সব সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ রাখতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নেসকো রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী শাহাদত হোসেন। তিনি বলেন, বিভাগের আট জেলায় চাহিদার অর্ধেক বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে লোডশেডিংয়ের সময়সূচি রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।
রাজশাহী অঞ্চলে চলছে লোডশেডিং। এ লোডশেডিং এক ঘণ্টা করে চলবে বলে বিভিন্ন এলাকার জন্য শিডিউল প্রকাশ করে বিদ্যুৎ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (নেসকো)। কিন্তু মানা হচ্ছে না সেই শিডিউল। ফলে গতকালও অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ে রাজশাহী অঞ্চলের সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। এতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো রাজশাহীতেও এলাকাভিত্তিক সম্ভাব্য লোডশেডিংয়ের তালিকা ওয়েবসাইটে আপলোড করেছে নেসকো। কিন্তু সেই তালিকা মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। রাজশাহীজুড়ে চলা তাপপ্রবাহের তীব্রতায় অসুস্থ হওয়ার পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যেও চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
রাজশাহী বিভাগে লোডশেডিংয়ের সম্ভাব্য সময় ধরা হয়েছে সকাল ৯টা থেকে রাত ১১টার মধ্যে। সম্ভাব্য লোডশেডিংয়ের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৩২ মেগাওয়াটের মতো। নেসকোর তথ্য মতে, রাজশাহী বিভাগে ৪৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদার বিপরীতে ঘাটতি রয়েছে ৬০ মেগাওয়াট। ৪৭০ মেগাওয়াটের মধ্যে রাজশাহী মহানগরীতেই চাহিদা ১১০ মেগাওয়াট।
রাজশাহী ছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, বগুড়া, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ ও পাবনার বেশির ভাগ এলাকা ও রংপুর বিভাগে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে রয়েছে নেসকো। এ কোম্পানির গ্রাহক প্রায় ১৭ লাখ।
শিডিউল না মেনে অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের বিষয়টি স্বীকার করেছে নেসকো কর্তৃপক্ষ। রাজশাহী নেসকোর প্রধান প্রকৌশলী আবদুর রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, যারা লোডশেডিং দিচ্ছেন অর্থাৎ স্থানীয় গ্রিড অফিস, তারা এখনো শতভাগ বুঝে উঠতে পারেননি। তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে কিভাবে লোডশেডিং দিতে হবে। গ্রিড অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যখন তাদের নির্দেশ দিবে তখন তারা লোডশেডিংয়ের নির্দেশনা শতভাগ মানবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের বিগত দিনের সীমাহীন লুটপাট, দুর্নীতি, অর্থপাচারের কারণে দেশ আজ এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রতিনিয়ত আশংকাজনকভাবে কমছে। ফলে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সাধারণ ক্রয় ক্ষমতার বাহিরে। আজ অভাবের কারণে মানুষ হাহাকার করছে।
দেশ ভয়াবহ সঙ্কটের দিকে। তারা বিদ্যুৎখাতের সকল অনিয়ম, দুর্নীতি ও চুরি বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেন, এগুলো বন্ধ করতে পারলে দেশবাসীকে ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের দুর্ভোগ পোহাতে হবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫০
আপনার মতামত জানানঃ