১৯৩৩ সালের ২৬ নভেম্বর তরুণ জমিদার অমরেন্দ্র চন্দ্র পান্ডে পরিবার নিয়ে ঝাড়খণ্ডে যাবার উদ্দেশ্যে কলকাতার হাওড়া রেল স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন। ভীড়ের মধ্যে হঠাৎ তার ডান হাতে একটি খোঁচা অনুভব করলেন। জনবহুল স্টেশনে কে খোঁচা দিলো তা বোঝা যায়নি। তবে সঙ্গে থাকা আত্মীয়রা তাকে ঝাড়খণ্ডে না গিয়ে, রক্ত পরীক্ষা করতে বলেন।
যদিও সেদিন কোনোরকম খবর না দিয়েই অমরেন্দ্রর বড় ভাই বিনয়েন্দ্র স্টেশনে উপস্থিত হন। তিনি তাকে স্টেশনে দেরি না করে চলে যেতে বললেন। ঝাড়খণ্ডে গিয়ে জ্বরাক্রান্ত হলে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন।
ডাক্তার অমরেন্দ্রকে পরীক্ষা করেন। তিনি অমরেন্দ্রর শরীরে হাইপোডার্মিক নিডলের (এক প্রকার সূচ, যা চিকিৎসাকার্যে ব্যবহৃত হয়) দাগ দেখতে পেলেন। এখানেই তিনি খোঁচা অনুভব করেছিলেন। কয়েকদিন পরে এই তরুণ জমিদার ভীষণ জ্বরাক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন।
ডাক্তার বলেছিল তিনি নিউমোনিয়াতে মারা গিয়েছেন। তবে, তার মৃত্যুর পর ল্যাব টেস্টে তার রক্তে Yersinia pestis নামক ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া যায়। এই ব্যাকটেরিয়ার কারণেই মরণঘাতী প্লেগে আক্রান্ত হতো মানুষ। সাধারণত, প্লেগ বাদুড় এবং মাছির মাধ্যমে ছড়ায়। ১৮৯৬-১৯১৮ সালে প্লেগে আক্রান্ত হয়ে ভারতের ১২ মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছিলেন।
তরুণ জমিদারের এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড পুরো ভারতবাসীকে বেশ নাড়া দিয়েছিল। কারোর মতে এটিই ছিল আধুনিক বিশ্বে ‘জৈব সন্ত্রাসের’ মাধ্যমে প্রথম হত্যাকাণ্ড। পত্রপত্রিকাতেও এই ঘটনা নিয়ে বেশ তোলপাড় শুরু হয়। টাইম ম্যাগাজিনের মতে এটি ছিল ‘জীবাণু দিয়ে হত্যা’। সিংগাপুরের স্ট্রেইট টাইমস একে ‘ছিদ্র হাতের রহস্য’ বলে আখ্যা দেয়।
তদন্ত শেষে পুলিশ এই হত্যাকাণ্ডে বেশ বড় ধরনের ষড়যন্ত্র খুঁজে পায়। তাদের মতে, তরুণ জমিদারকে হত্যার জন্য ১৯০০ কিলোমিটার দূরের শহর মুম্বাইয়ের এক হাসপাতাল থেকে এই ব্যাকটেরিয়ার জীবাণু আনা হয়েছিল।
পুলিশ এই হত্যাকাণ্ডে পারিবারিক বিরোধের কথা উল্লেখ করে। জমিদারের অন্য সৎ ভাইয়েরা প্রায় দুই বছর ধরে তাদের পিতার রেখে যাওয়া সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল। বিশেষত, কয়লার খনির জন্য বিখ্যাত ‘পাকুড়’ এলাকায় তাদের বিশাল জমিজমা নিয়ে বিরোধ ছিল প্রকট।
স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে জমিদারপুত্রদের এই বিরোধ তুলে ধরা হয়। অমরেন্দ্র ছিলেন তুমুল জনপ্রিয়, শিক্ষানুরাগী এবং নীতি-নৈতিকতা সম্পন্ন লোক। অন্যদিকে তার ভাই, বিনয়েন্দ্র উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করতেন। তিনি মদ এবং নারীসঙ্গের প্রতি অধিক মনোযোগী ছিলেন।
সূত্র মতে, বিনয়েন্দ্র’র এক বন্ধু ছিলেন তারানাথ ভট্টাচার্য। তিনি ছিলেন ডাক্তার। ১৯৩২ সালে তিনি ল্যাবরেটরিতে প্লেগের উৎপত্তি বিষয়ে গবেষণা করে ব্যর্থ হন। কোর্টের ডকুমেন্টের মাধ্যমে জানা যায় যে, বিনয়েন্দ্র ওই বছরই তার ভাইকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল। একবার দুইভাই পাহাড়ি এলাকায় হাঁটতে বের হলে বিনয়েন্দ্র একজোড়া চশমা জোড় করে অমরেন্দ্র’র নাকের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন। এতে নাকের অনেকটা চামড়া কেটে যায়।
ব্রিটিশ স্বাস্থ্য অফিসার ডিপি ল্যাম্বার্টের মতে, ‘চশমাটি বিনয়েন্দ্র বিশেষভাবে বানিয়ে এনেছিল। চশমাটি টিটেনাসের জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত ছিল। ফলে পরবর্তী কয়েকমাস অমরেন্দ্র বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে তাকে এন্টি-টিটেনাস সেরাম দিয়ে সুস্থ করা হয়। অবশ্য বিনয় বাবু তখনও ডাক্তার দিয়ে বেশ কয়েকবার ভূল চিকিৎসা করার চেষ্টা করেছিলেন। প্রতিবারই তিনি ব্যর্থ হন’।
পরবর্তীকালে যা ঘটেছিল তা অবশ্য সেসময়ের চাইতে এগিয়ে ছিল। বিনয়েন্দ্রর বন্ধু ভট্টাচার্য প্লেগ ব্যাকটেরিয়ার কালচার করতে মোট চারবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। প্রতিবারই তিনি ব্যর্থ হন। ১৯৩২ সালে ভট্টাচার্য, মুম্বাইয়ের হফকিন ইন্সটিটিউটের পরিচালকের সাথে যোগাযোগ করেন। মুম্বাইয়ের এই একটি ল্যাবরেটরিতেই প্লেগের জীবাণু সংরক্ষিত ছিল। ল্যাবের পরিচালক ভট্টাচার্যের অনুরোধ নাকচ করে দেন।
পরে তিনি কলকাতার এক ডাক্তারকে জানান যে তিনি প্লেগের একটি প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছেন। এটি পরীক্ষা করতে তার প্লেগের জীবাণু প্রয়োজন। ঐ ডাক্তার তাকে পরীক্ষার অনুমতি দেন। তবে, জীবাণুর কালচার করা থেকে তাকে বিরত থাকার পরামর্শও দেন।
১৯৩৩ সালে ভট্টাচার্য আবারও ঐ ডাক্তারকে হফকিন ইন্সটিটিউটের পরিচালককে একটি সুপারিশপত্র দিতে প্ররোচিত করেন। এ সময় ডাক্তার হপকিন ইন্সটিটিউটের পরিচালককে অনুরোধ করেন ভট্টাচার্যকে যেন তাদের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করার সুযোগ দেয়া হয়। ওইবছর গ্রীষ্মে বিনয়েন্দ্র মুম্বাইতে যান। ভট্টাচার্যকে সাথে নিয়ে তিনি দুজন অভিজ্ঞ সার্জনকে প্লেগের জীবাণু এনে দিতে ঘুষ দেন। নিজেদের ঝানু বিজ্ঞানী বোঝানোর জন্য বিনয়েন্দ্র বাজার থেকে দুটি ইঁদুর কিনেছিল।
যাইহোক, এরপর সার্জন দুজন আর্থার রোডের ইনফেকশিয়াস ডিজিজেস হসপিটাল থেকে জীবাণু নিয়ে আসেন। কোর্টের ডকুমেন্টস থেকে জানা যায়, বিনয়েন্দ্র তার ল্যাবরেটরি কর্তৃপক্ষকে রাজি করান যেন ভট্টাচার্য ও তার লোকজনকে ল্যাবেরটরিতে কাজ করতে দেয়া হয়। তবে, বিনয়েন্দ্রর নিজে পরীক্ষাকার্যে সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়না। পাঁচ দিন পরে, ১২ জুলাই, দুই বন্ধু হঠাৎ-ই কাজ বন্ধ করে দিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন।
১৯৩৪ সালে, হত্যাকাণ্ডের তিনমাস পরে পুলিশ দুজনকে গ্রেপ্তার করে। তদন্তকারীরা বিনয়েন্দ্রর মুম্বাইয়ের হোটেল বিল, হোটেলের রেজিস্ট্রি বইয়ে তার হাতের লেখা, ল্যাবরেটরিতে তার দেয়া চিঠিপত্র, ইঁদুর কেনার রশিদসহ যাবতীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করে। দীর্ঘ নয় মাসের গবেষণা যেন প্রকাশ হতে লাগলো। কোর্টে ডিফেন্স থেকে বলা হয়, অমরেন্দ্রকে ইঁদুর কামড় দেয়াতে তার মৃত্যু হয়েছিল।
কিন্তু কোর্ট প্রমাণসাপেক্ষে উক্ত দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে রায় দেন। তাদের বিরুদ্ধে ‘প্লেগের ব্যকটেরিয়া চুরি’ এবং ‘জীবাণু দিয়ে হত্যা’র অভিযোগ আনে। কোর্ট প্রমাণ পায় বিনয়েন্দ্র এবং তার বন্ধু ভট্টাচার্য, অমরেন্দ্রকে হত্যায় গুপ্তঘাতক নিয়োগ করেছিল। তাদের দুইজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৩৬ সালে বিনয়েন্দ্রর আইনজীবী কলকাতার হাই কোর্টে আপিল করেন। রায়ে তাদের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়। অন্য দুই ডাক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তার খালাস পেয়ে যান।
মামলার শুনানিতে একজন বিচারক মন্তব্য করেছিলেন, ‘ইতিহাসে এটি একটি অনন্য অপরাধ’। ‘দ্যা প্রিন্স এন্ড দ্যা পয়জনার’ গ্রন্থের লেখক ও সাংবাদিক ড্যান মরিসন বলেছিলেন, বিনয়েন্দ্র ভেবছিল তিনি ২০ শতকের একজন চালাক ব্যক্তি যিনি ভারতবর্ষের ভিক্টোরিয়ান ইন্সটিটিউটগুলোকে বোকা বানাতে পারবেন। তবে রেলস্টেশনের এই হত্যাকাণ্ড বেশ আধুনিক পদ্ধতির ছিল’।
কৃতজ্ঞতা: পনিচুজ্জামান সাচ্চু
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৪২
আপনার মতামত জানানঃ