উচ্ছিষ্ট বা বর্জ্য হিসেবে কুরবানি পশুর ফেলে দেয়া অঙ্গ প্রত্যঙ্গও দেশের জন্য নিয়ে আসছে বৈদেশিক মুদ্রা। শুধু চামড়া নয়, পশুর যৌনাঙ্গ, মুত্রথলি, পিত্ত, তিল্লি, লেজ, রক্ত, হাড়, শিং, চর্বি কোনো কিছুই এখন আর ফেলনা নয়। সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের রয়েছে বহুমাত্রিক ব্যবহার ও বিরাট অর্থমূল্য। এদের ঘিরে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগে দেশেই গড়ে উঠেছে হরেক পণ্যের শিল্প-কারখানাও। হচ্ছে রপ্তানি।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও মাংস ব্যবসায়ীদের হিসাবে প্রতি বছর গড়ে ১ কোটি ৪০ লাখের মতো গরু ও মহিষ জবাই হয়। এর মধ্যে ৬০ লাখই জবাই হয় গরু। আর সারা বছরে মোট জবাইয়ের ৬০ শতাংশই হয় কুরবানির ঈদে।
বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি ও বাংলাদেশ বোন এক্সপোর্টার অ্যান্ড মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে আবর্জনা হিসেবে ফেলে দেয়া গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে বিভিন্ন শিল্প কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করা হচ্ছে।
যেভাবে ব্যবহৃত হয় এইসব উচ্ছিষ্ট অংশ
যেমন পশুর যৌনাঙ্গ। দেশে ফেলে দেয়া এই অঙ্গ জাপান, কোরিয়া, চীন, জার্মানিসহ কয়েকটি দেশে জনপ্রিয় খাবার তৈরি হয়। এই বিষয়টি জেনে পশুর লিঙ্গ ও অণ্ডকোষ রপ্তানি করে নিজের ভাগ্য পাল্টে ফেলেছেন বহুজন। গরুর একটি লিঙ্গ ও অণ্ডকোষ আন্তর্জাতিক বাজারে ন্যূনতম ৫ ডলার- যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪৫০ টাকার বেশি।
পশুর অণ্ডকোষ দিয়ে সসেজ রোল এবং স্যুপসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করা হয়। বিশেষ করে গরুর যৌনাঙ্গ দিয়ে তৈরি স্যুপ চীনাদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয়।
গরুর পিত্ত, তিল্লি ও কলিজার সঙ্গে রাসায়নিক উপাদানের সংমিশ্রণে উৎপাদন করা হয় বিভিন্ন জীবন রক্ষাকারী সিরাপ।
হাড় দিয়ে তৈরি হয় ক্যাপসুলের শেল বা খোলসহ শিল্পের যুগান্তকারী উপাদান জিলেটিন, যা বিভিন্ন খাদ্য ও প্রসাধনী পণ্যেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। অর্থাৎ ওষুধ ও সিরামিক শিল্পের কাঁচামাল হিসেবেও হাড় ব্যবহৃত হয়। শিশুসামগ্রী, শো-পিসসহ ঘর সাজানোর নানা উপকরণেও হাড়ের ব্যবহারের জুড়ি নেই।
অপরদিকে ক্ষুর দিয়ে বিভিন্ন প্রকার ক্লিপ ও লেজ দিয়ে তৈরি হচ্ছে ব্রাশ, আর চর্বিতে তৈরি হয় সাবান।
সাতপল্লা বা গোল্লাও তাদের কাছে উন্নতমানের খাবার হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। আর নাড়ি দিয়ে জাপানে তৈরি করা হয় মজাদার সুস্যেট। শিং দিয়ে তৈরি হয় বিশেষ ধরনের বোতাম, চিরুনি, ডিভিডি, অডিও ফিল্ম।
খাসির নাড়ি অনেক সময় অপারেশন থিয়েটারে সুতা হিসেবে ব্যবহার হয়। যে রক্ত ঝরে, তা সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে তৈরি হয় বিভিন্ন পশু-পাখির খাদ্য।
জমাটবাঁধা রক্তের সঙ্গে শুঁটকি, তিল, কাউন ও সয়াবিনের সংমিশ্রণে তৈরি করা হয় পশুখাদ্য। এ খাদ্য বেশ প্রোটিনসমৃদ্ধ। ব্রয়লার মুরগিকে খাওয়ানো হয় এসব।
হাজার কোটি টাকার বাজার
পশুর বহুমাত্রিক ব্যবহারের কারণে দেশে এখন পশুর বর্জ্যের ব্যবসার অল্প হলেও প্রসার ঘটেছে। এর বিশ্ববাজারও বড় হচ্ছে। দেশি লেনদেন ও বৈদেশিক আয় মিলে ইতিমধ্যে পশুর বর্জ্যের বাজার ছাড়িয়েছে হাজার কোটি টাকার উপরে।
ফলে দেশে পশুর বর্জ্যের চাহিদা এবং দাম দুটোই বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি বাণিজ্যিক সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে হাড়।
ব্যবসা সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জিঞ্জিরা ও হাজারীবাগেই এখন পশুর প্রত্যঙ্গের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শতাধিক। দেশের সাবান শিল্পের চর্বির বড় জোগানদারও হাজারীবাগের কারখানাগুলো।
মাংস ব্যবসায়ী, পথশিশু, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও ফেরিওয়ালারা এসব বর্জ্যের প্রধান সংগ্রাহক, যা তারা হাজারিবাগ পোস্তাসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন ভাঙারি দোকানে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেজি হিসাবে বিক্রি করে থাকেন।
কেজি হিসেবে পশুর অণ্ডকোষ ও লিঙ্গ ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা, আকারভেদে শিং ৬৫ থেকে ৮৫ টাকা, চর্বি ৪০ থেকে ৬০ টাকা, রক্ত ১০ থেকে ১৫ টাকা, হাড়, মাথা, দাঁত বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ টাকা কেজিতে। এছাড়া শুকনো হাড়ের কেজি ২০ থেকে ২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব মো. রবিউল আলম বলেন, ‘আমরা উচ্ছিষ্ট হিসেবে গবাদি পশুর যেসব অংশ ফেলে দেই বিদেশিরা সেগুলো কিনে নেয় ডলার দিয়ে।’
‘একটি মাঝারি আকারের গরুতে ১৫ থেকে ২০ কেজি হাড় ফেলে দেয়া হয়। এভাবে শুধুমাত্র কুরবানির ঈদ ও পরবর্তী এক মাসে সারাদেশে প্রায় ৩০ হাজার টন হাড় সংগ্রহ করা হয়। প্রতিদিন এই হাড় নিয়ে প্রায় অর্ধ লাখ থেকে কোটি টাকা এবং নাড়িভুঁড়ি বিক্রিতে কমপক্ষে ২৫ লাখ টাকার বাণিজ্য হয়।’
তবু অপচয় হচ্ছে মূল্যবান জিনিসের
পশুর বর্জ্য সংগ্রাহক ও রপ্তানিকারকরা কুরবানির পশুর বর্জ্য সংগ্রহে এখন মাঠে রয়েছেন। তবে এখনও এ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর সংখ্যা অতি নগণ্য। যারা রয়েছেন তাদের বিনিয়োগও খুব কম। এ কারণে তারা সারা দেশে মাঠ পর্যায়ের সব বর্জ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে পারছে না।
কুরবানিদাতাদের মধ্যে সচেতনতার অভাবও লক্ষ্যনীয়। অধিকাংশ কুরবানিদাতাই পশুর শরীরের চামড়া এবং মাংস আলাদা করে নেয়ার পর পশুর অন্যান্য অংশগুলো ফেলনা বস্তু হিসেবে অবহেলায় ফেলে রাখেন। ফলে শেষ পর্যন্ত এ বর্জ্য যায় ডাস্টবিন হয়ে ডাম্পিং ইয়ার্ডে, আর গ্রামের ক্ষেত্রে নদী কিংবা জঙ্গলে।
দূষণের ভয়ে রক্ত মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়। কোথাও আবার তা পানিতে ধুয়ে-মুছে সাফ করে দেয়া হয়। কারণ, রাষ্ট্রীয়ভাবেই পশুর শরীরের পরিত্যক্ত এসব বর্জ্য দ্রুত ও নিরাপদ স্থানে সরিয়ে ফেলার নির্দেশ রয়েছে।
এ বিষয়ে ডকুমেন্টারি তৈরি করে তা প্রচারও করা হচ্ছে। অথচ বলা হয় না, এদের কোনো কিছুই ফেলনা নয়। পশুর বর্জ্যও মূল্যবান। এগুলো পরিকল্পিত উপায়ে সংগ্রহ করুন।
চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের উৎপাদক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিএফএলএফএমইএর সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন বলেন, ‘এটা ঠিক, দেশে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের ব্যবসা বড় হলেও পশুর বর্জ্যের ব্যবসায় তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। তার মানে এই নয়, ভবিষ্যতে কেউ দেবে না।’
সাবেক বাণিজ্য ও অর্থ সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন বলেন, উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছানোর প্রক্রিয়াটি টেকসই করতে হলে দেশের প্রতিটি সম্পদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। বাড়াতে হবে উৎপাদন, পরিমাণ এবং গুণগত মান। যেখানে সুযোগ ও সম্ভাবনা থাকবে, সেখানে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
বিশেষ করে রপ্তানি সম্ভাবনাময় সব নিত্যনতুন পণ্যকে গুরুত্ব দিতে হবে। বৈদেশিক মিশন ও বাণিজ্যিক শাখাগুলোর কোন দেশে কি ধরনের পণ্যের চাহিদা রয়েছে তার বাজার খোঁজ অব্যাহত রাখতে হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৫৭
আপনার মতামত জানানঃ